পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭২
জননী

শ্যামা ঘরে আসিয়াছে। তখন সে বিধানের বইএর পাতায় একস্থানে আঙ্গুল দিয়া বলে: এখানটা ভাল করে বঝে পড়িস খোকা, পরীক্ষায় মাঝে মাঝে দেয়। তারপর বিধান জিজ্ঞাসা করে: Circumlocutory মানে কি বাবা? শীতল বলে, দেখ্ না দেখ্, মানের বই দেখ্। বিধান তখন খিল খিল করিয়া হাসে। শ্যামা বলে: পড়ার সময় কেন ওকে বিরক্ত করছ বলত?

 শীতল বলে, হাসলি যে খোকা?—শীতলের মুখ মেঘের মত অন্ধকার হইয়া আসে, বাপের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে? হারামজাদা ছেলে কোথাকার! বলিয়া ছেলেকে সে আথালি পাথালি মারিতে আরম্ভ করে। বিধান চেঁচায়, বুকু চেঁচায়, শ্যামা চেঁচায়, বাড়িতে একেবারে হৈ চৈ বাধিয়া যায়। শ্যামা দুই হাতে বিধানকে বুকের মধ্যে আড়াল করে, শীতল গায়ের ঝাল ঝাড়িতেই শ্যামার গায়ে দুচারটা মার বসাইয়া দেয় অথবা সেগুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া শ্যামার গায়ে লাগে বুঝিবার উপায় থাকে না। শ্যামা তো আজ গৃহিণী, মোটাসোটা রাজরাণীর মত তাহার চেহারা, শীতল কি এখন তাহাকে ইচ্ছা করিয়া মারিবে?

 এমনিভাবে দিন যায়, ঠাণ্ডায় শীতের দিনগুলি হ্রস্ব হইয়া আসে। মামা সেই যে একবার শ্যামাকে কুড়িটি টাকা দিয়াছিল আজ পর্যন্ত সে আর একটি পয়সাও আনিয়া দেয় নাই, শ্যামা তবু শীতলের চেয়ে মামাকেই খাতির করে বেশি: মামার সঙ্গে শ্যামার বনে, শ্যামার ছেলেদের মামা বড় ভালবাসে, শীতলের চেয়েও বুঝি বেশি। নিজের বাড়িতে শীতল কেমন পরের মত থাকে, যে সব খাপছাড়া তাহার কাণ্ড, কে তাহার সঙ্গে আত্মীয়তা করিবে? শীতলকে ভালবাসে শুধু বকুল। মেয়েটার মন বড় বিচিত্র, যা কিছু, খাপছাড়া যা কিছু অসাধারণ তাই সে ভালবাসে। শীতলও বোধ হয় খোঁড়া কুকুর, লোম-ওঠা ঘা-ওলা বিড়াল, ভাঙা পুতুল এই সবের পর্যায়ে পড়ে, বকুল তাই শ্যামার ভাষায় বাবা বলিতে অজ্ঞান। ছেলেবেলা হইতে বকুলেব স্বাস্থ্যটি বড় ভাল, চলাফেরা হাসি খেলা স্বাভাবিক নিয়মে সবই তার সুন্দর, কত প্রাণ, কত ভঙ্গি। সকলে তাহাকে ভালবাসে, তার সঙ্গে কথা বলিতে সকলেই উৎসুক, সে কিন্তু যাকে তাকে ধরা দেয় না, নির্মমভাবে উপেক্ষা