পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

মমতার অভাবটা অনেকেই নানা উপায়ে ঘােষণা করিয়া থাকে। শীতলের উপায়টা ছিল বিকারগ্রস্ত—তাহার ভীরুতা ও দুর্বলতার বিষে বিষাক্ত। যেসব বােকার দল চিরকাল বুদ্ধিমানদের ভােজ দিয়া আসিয়াছে, সে ছিল তাদের রাজা। বন্ধুরা পিঠ চাপড়াইয়া তাহার মনকে গড়ের মাঠের সঙ্গে তুলনা করিত, তাই পাছে কেহ টের পায় যে মন তাহার আসলে বড়বাজারের গলি, এই ভয়ে সর্বদা সে সন্ত্রস্ত হইয়া থাকিত। ফেরত পাইবে না জানিয়া টাকা ধার দিত সে, চাঁদার খাতায় মােটা টাকা সই করিত সে, থিয়েটারের বক্স ভাড়া করিত সে, মদ ও আনুষঙ্গিকের টাকা আসিত তাহারই পকেট হইতে। বিকালের দিকে প্রেসের ছােট আপিসটিতে হাসিমুখে সিগারেট টানিতে টানিতে দু'চার জন বন্ধুর আবির্ভাব হইলে ভয়ে তাহার মুখ কালাে হইয়া যাইত। পাগলামি ছিল তাহার এইখানে। সে জানিত বােকা পাইয়া সকলে তাহার ঘাড় ভাঙ্গে, তবু ঘাড় ভাঙ্গিতে না দিয়াও সে পারিত না।

 শেষে, শ্যামার বিবাহের প্রায় চারবছর পরে, শীতলের প্রেস বিক্রয় হইয়া গেল। আবােল তাবােল যেমনি খরচ করুক আয় ভাল থাকায় এতকাল মােটামুটি একরকম চলিয়া যাইত, প্রেস বিক্রয় হইয়া যাওয়ার পর তাহাদের কষ্টের সীমা ছিল না। বাড়িটা পৈত্রিক না হইলে মাঝখানে কিছু দিনের জন্য হত তাহাদের গাছতলাই সার করিতে হইত। এই অভাবের সময় শ্যামার মামার সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হওয়ার শোক শীতলের উথলিয়া উঠিয়াছিল, সব সময় শ্যামাকে কথার খোঁচা দিয়াই তাহার সাধ মিটিত না। শ্যামার গায়ে তাহার প্রমাণ আছে। প্রথম মা হওয়ার সময় শ্যামার কোমরের কাছে যে মস্ত ক্ষতের দাগটা দেখিয়া বুড়ী দাই আপশােষ করিয়াছিল এবং শ্যামা বলিয়াছিল ওটা ফোঁড়ার দাগ, ছড়ির ডগাতেও সেটা সৃষ্টি হয় নাই, ছাতির ডগাতেও নয়। ওটা বঁটিতে কাটার দাগ। বঁটি দিয়া শীতল অবশ্য তাহাকে খোঁচায় নাই, পা দিয়া পিঠে একটা ঠেলা মারিয়ছিল। দুঃখের বিষয়, শ্যামা তখন কুটিতেছিল তরকারী।

 তরকারী সে আজো কোটে। সুখে দুঃখে জীবনটা অমনি হইয়া গিয়াছে, সিদ্ধ করিবার চাল ও কুটিবার তরকারী থাকার মত, চলনসই। অনেকদিন প্রেসের মালিক হইয়া থাকার গুণে একটা প্রেসের ম্যানেজারির