পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
৮৯

দেখিয়া শুধু নয়, কবে শীতল ভুলিতে পারিয়াছিল তার চেয়ে পরাধীন কেহ নাই, সৃষ্টিতত্ত্বের সে গোলাম, জেলে যাওয়ার, মরিয়া যাওয়ার অধিকার তাহার নাই? সে পাগল বলিয়াই না এ কথা ভুলিয়া গিয়াছিল? জানালা বন্ধ ঘরে শীতের স্তব্ধ রাত্রি, এই ঘরে দায়ে পড়া স্নেহ মমতার সঙ্গে সুখশান্তির বিরাট সমন্বয়টা দিনে আসিলে বোঝা যাইত না। এই ঘরে এমনি শীতের রাত্রে লেপ মুড়ি দিয়া সে কতকাল ঘুমাইয়াছে। তুচ্ছ তুলার তোষকে, তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘুম। তেমনি ভাবে আর সে কোন দিন এখানে ঘুমাইতে পারিবে না। তুচ্ছ তুলার তোষকে তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘুম আজ কত দুর্লভ।

 ধীরে ধীরে তাহারা কথা বলিতে লাগিল, দুজনের মাঝে যেন দুস্তর ব্যবধান। একজন কথা বলিলে এতটা দূরত্ব অতিক্রম করিয়া আরেকজনের কাছে পৌঁছিতে যেন সময় লাগে।

 শ্যামা বলিল, টাকা কি সব খরচ করে ফেলেছ?

 শীতল বলিল, না, দুচার শ বোধ হয় গেছে মোটে।

 শ্যামা বলিল, তাহলে কালকেই তুমি যাও কমলবাবুর হাতে পায়ে ধরে পড় গিয়ে, টাকা ফিরে পেলে তিনি বোধ হয় আর গোলমাল করবেন না।

 শীতল বলিল, যদি করেন গোলমাল? তাহলে টাকাও যাবে, জেলও খাটব। তার চেয়ে আমার পালানোই ভাল। তোমায় যে টাকা দিয়ে গেছি তাইতেই এখন চলবে। আমি পশ্চিমে চলে যাই, সেখানে দোকান টোকান দিয়ে যা করে হোক রোজগারের একটা পথ করে নিতে পারব। মাঝে মাঝে দেশে এসে এমনি রাত দুপুরে তোমার সঙ্গে দেখা করে টাকা পয়সা দিয়ে যাব। তারপর দু’চার বছর কেটে গেলে বাড়িটা বিক্রি করে তোমরা এদিক ওদিক কিছু দিন ঘুরে ফিরে আমি যেখানে থাকব সেইখানে চলে যাবে। ছ’ হাজার টাকার তো মামলা, কে আর অতদিন মনে করে রাখবে। কমলবাবুও ভুলে যাবে, পুলিসেও খোঁজটোঁজ আর নেবে না।

 শ্যামা বলিল, বাড়ি বিক্রি করব কি করে? বাড়ি তো তোমার নামে।

 এতক্ষণে শীতল একটু হাসিল, বলিল, সে আমি তোমায় কবে দান করে দিয়েছি, খুকি হবার সময় আমার একবার অসুখ হয়েছিল না?—