পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৪
জননী

নিষ্ঠুর? সময় সময় শ্যামার মনে হইত ছেলে যেন পাষাণ, রক্তমাংসে তৈরি বুক ওর নাই। তারপর ওর প্রকৃতির কত বিচিত্র দিক স্পষ্ট হইয়া উঠিয়া আবার ওর মধ্যেই কোথায় লুকাইয়া গিয়াছে,—একটির পর একটি দুর্বোধ্যতা, রাশি রাশি মুখোস পরিয়া সে যেন জন্মিয়াছিল, একে একে খুলিয়া চলিয়াছে, ওর আসল পরিচয় আজো শ্যামা চিনিল না। কত সময় সে ভয় পাইয়া ভাবিয়াছে, বাপের পাগলামিই কি ছেলের মধ্যে প্রবলতর হইয়া দেখা দিতেছে, ওকি একদিন পাগল হইয়া যাইবে? অত কি ভাবে ও? সময় সময় জননীর উন্মাদ ভালবাসাকে কেমন করিয়া দুপায়ে মাড়াইয়া চলে অতটুকু ছেলে! বিধানকে মনে মনে শ্যামা ভয় করে। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি যাওয়ার কথা ওকে সে বলিতে পারিল না।

 বিধান বলিল, ওদের গাড়িতে আমি আর স্কুলে যাব না মা, কখ্‌খনো কোনদিন যাব না।

 ওরা যদি আদর করে ডাকতে আসে?

 ডাকতে এলে মেরে তাড়িয়ে দেব।

 শুনিয়া শ্যামারও মনে হইল এই তো ঠিক, অত অপমান তাহারা সহিবে কেন? যাদের মোটর নাই ছেলে কি তাদের স্কুলে যায় না? সহসা উদ্ধত আত্মসম্মান জ্ঞানে শ্যামার হৃদয় ভরিয়া গেল। না, শঙ্করের সঙ্গে গাড়িতে তাহার ছেলেকে স্কুলে যাইতে দেওয়ার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়ার তোষামোদ সে করিবে না।

 পরদিন মামার সঙ্গে ছেলেকে সে স্কুলে পাঠাইয়া দিল। বলিল, এ মাসের ক’টা দিন মোটে বাকি আছে, একটা দিন ট্রামে নগদ টিকিট কিনে ওকে স্কুলে দিয়ে এসো নিয়ে এসো মামা, এ’কদিন তোমার সঙ্গে এলে গেলে তারপর ও নিজেই যাতায়াত করতে পারবে, মাস কাবারে কিনে দেব একটা মাসিক টিকিট।

 বিধান অবজ্ঞার সুরে বলিল, যা তুমি খালি ভাব!—আমার চেয়ে কত ছোট ছেলে একলা ট্রামে চেপে স্কুলে যায়। আমি যেখানে খুসি যেতে পারি মা,—যাইনি ভাবছ? ট্রামে করে কদ্দিন গেছি চিড়িয়াখানায় চলে।