পাতা:জাপানে-পারস্যে-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৩

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
পারস্যে
১৩৩

 মধ্যাহ্ন পেরিয়ে যায়। শিরাজের পথ দীর্ঘ। একদিনে যেতে কষ্ট হবে বলে স্থির হয়েছে খাজরুনে গবর্ণরের আতিথ্যে মধ্যাহ্নভোজন সেরে রাত্রিযাপন করব। কিন্তু বিলম্বে বেরিয়েছি, সময়মতো সেখানে পৌঁছবার আশা নেই, তাই পথে কোনার্‌তাখ্‌তে নামে এক জায়গায় প্রহরীদের মেটে আড্ডায় আমাদের মোটর গাড়ি থামল। মাটির মেঝের পরে তাড়াতাড়ি কম্বল কার্পেট বিছিয়ে দিলে। সঙ্গে আহার্য ছিল, খেয়ে নিলুম। মনে হল, এ যেন বইয়ে পড়া গল্পের পান্থশালা, খেজুর-কুঞ্জের মাঝখানে।

 এবার পাহাড়ে আঁকাবাঁকা চড়াই পথে উঠছি। পাহাড়গুলো সম্পূর্ণ টাক-পড়া, এমন কি, পাথরেরও প্রাধান্য কম। বড়ো বড়ো মাটির স্তুূপ। যেন মুড়িয়ে দেওয়া দৈত্যের মাথা! বোঝা যায় এটা বৃষ্টি-বিরল দেশ, নইলে গাছের শিকড় যে-মাটিকে বেঁধে রাখে নি বৃষ্টির আঘাতে সে মাটি কতদিন টিকতে পারে। স্বল্পপথিক পথে মাঝে মাঝে কেরোসিনের বোঝা নিয়ে গাধা চলেছে। বোঝাইকরা বড়ো বড়ো সরকারী মোটর বাস আমাদের পথ বাঁচিয়ে নড়বড় করে ছুটেছে নিচের দিকে। পাহাড়ের পর পাহাড়, তৃণহীন জনহীন রুক্ষ, যেন পৃথিবীর বুক থেকে একটা তৃষার্ত দৈন্যের অশ্রুহীন কান্না ফুলে ফুলে উঠে শক্ত হয়ে গেছে।

 বেলা যায়। একজায়গায় দেখি পথের মধ্যে খাজরুনের গবর্ণর ঘোড়সওয়ার পাঠিয়েছেন আমাদের আগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। বোঝা গেল তাঁরা অনেকক্ষণ ধরে প্রতীক্ষা করছেন।

 প্রাসাদে পৌঁঁছলুম। বড়ো বড়ো কমলালেবু গাছের ঘন সংহত বীথিকা; স্নিগ্ধচ্ছায়ায় চোখ জুড়িয়ে দিলে। সেকালের মনোরম বাগান, নাম বাঘ-ই-নজর। নিঃস্ব রিক্ততার মাঝখানে হঠাৎ এই রকম সবুজ ঐশ্বর্যের দানসত্র, এইটেই পারস্যের বিশেষত্ব।