পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চুরুটে একটান দিয়ে—‘দাড়াও, তোমাকে বাতলে দিচ্ছি আমি। চুরুটটা ফেলে দিয়ে, পকেট থেকে আর-একটা চুরুট বার করে—‘পঞ্চাশ বছরই তো এ-সব করলাম বসে-বসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তোমাকে লাভ নেই বাছা। তুমি আমার বন্ধুর ছেলে—অন্তত পঞ্চাশ একর আবাদি জমি যদি না জোগাড় করতে পার, চাষবাসের কাজে হাত দিয়ে কোনো ফয়শালা নেই।’ বললেন—তা যদি জোগাড় করতে পার, তা হলে পেটে ভাত খেয়ে থাকতে পারবে। পকেট থেকে দেশলাই বার করে—কিন্তু জমি গেলেই তো হল না শুধু, আরো দুহাজার মূলধন লাগবে। দেশলাই-এর গায়ে একটা কাঠি ঘযতে-ঘষতে—"পরে যদি একশো একর জমি আর চার হাজার টাকা ক্যাপিটাল জোগাড় করতে পার তা হলে মাথার ঘাম পায় ফেলে উপার্জন করলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ তোয়াজেই থাকতে পারবে। কাঠিটা জুলিতে না-জুলিতেই নিভে হাতের থেকে পড়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে—কিন্তু দশ-বিশ একর জমিতে কিছু কাজ হবে না। তা তোমাকে অনেক আগেই বলে রাখছি। দশ একর জমি নিয়ে একজন আনাড়ি হয়তো বড় জোর পনেরো-বিশ টাকা সংস্থান করতে পারবে। একজন ঘুঘু পারবে হন্দ পঞ্চাশ টাকা, কিন্তু তাও ধরো যদি বন্যা হয় বা অনাবৃষ্টি-অজন্মা, তাহলে তো সবই গেল। ভগবান আমাদের নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসেন। এত বড় সৃষ্টি ফাদিয়ে বসে কী করবেনই-বা আর। কাজেই কখনো আকাশ থাকে শুকিয়ে, কখনো পৃথিবী যায় ডুবে। আর-একটা কাঠি জুলিতে চেষ্টা করলেন যদুনাথবাবু। সেটাও নিভে গেল। —কাজেই টাকার জোর থাকা চাই। অন্তত লাখ-দেড়লাখ টাকা মজুদ না থাকলে জমি নিয়ে খেলা করা বিড়ম্বনা; তার চেয়ে পরস্ত্রী নিয়ে ইয়ার্কি করাও ঢের নিরাপদ। এই কথাটা তোমাদের আমি বুঝিয়ে দিতে চাই। ...একদল ছেলে খেকিয়ে উঠেছে ভাদ্রমাসের কুত্তার মতো—জমি চাষ করে তারা বড়লোক হবে। পারবে ? এইবার ভালো করে কাঠি জুলিয়ে চুরুট জুলিয়ে নিলেন যদুনাথবাবু। বললেন, ‘রোজ এগারো ঘণ্টা কাজ করতে পারবে ? যদি বলি লাঙল ধরে ষোলো ঘণ্টা, তা হলে তো, আচ্ছা, লাঙল না ধরেই ষোলো ঘণ্টা। যে-সব কিষান খাটাচ্ছ তাদের কাজকর্ম তদারকি করতে হবে। তাদের কাছ থেকে ষোলো আনা কাজ আদায় করে নিতে হবে। —অন্তত দশ-পনেরো বছরের মধ্যে নভেল বা নারীর মুখ দেখতে পারবে না, থিয়টোরে যেতে পারবে না, বায়োস্কোপ দেখবার জো নেই। বাপ, মা, ভাই বন্ধু, স্ত্রী, প্রণয়িনী উচ্ছন্ন গেলেও ভূক্ষেপ করতে পারবে না। সৃষ্টির বিধাতা যেমন হৃদয়হীন ও অন্যকর্ম, অক্লান্ত ও ধূর্ত, তেমনি করে তোমাকেও জমি পাহারা দিয়ে বেড়াতে হবে।’ নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম দু-জনে। —‘দেখো, যদিপার, অনেক ছোকরাকে দেখেছি বোশেখ-জ্যৈষ্ঠের বা-বা আগুনের মধ্যে দশ-বারো ঘণ্টা—একটা শয়তানেও পারে না। কিন্তু সেই ধকলটাই জমির পিছন খাটাতে বললে তাদের চোখের তারা কপালে ওঠে। এমনই— চুরুটে এক টান দিয়ে–দিন-কাল ছিল তখন আমার, চোত-বোশেখের রোদে দশ ঘণ্টা, বিশ ঘণ্টা করে খেটেছি আমি। থার্মোমিটারে তখন একশো সত্তর ডিগ্রি। চুলের ভিতর আঙুল চালাতে-চালাতে যদুনাথ—সূর্য না-উঠতেই বেরিয়ে যেতাম, >の°