পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

খোকা হয়তো কারো কথাই শোনে না; সকালে ঘুমের থেকে উঠে একটা বাঁশের কঞ্চি কুড়িয়ে নেয় নিশ্চয়। তারপর? নয়তো বিড়াল, কুকুর, শালিক, কাক, যা তার নজরে আসে—সমস্ত তাড়িয়ে বেড়াতে খুব ভালো লাগে তার। হয়তো পিপড়ে মারে—ফড়িং ধরবার জন্য মেহেদি পাতার বেড়ার চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়—দু-একটা গঙ্গা-ফড়িং কিংবা নতুন বিবি যদি নজরে পড়ে তা হলে তার প্রতি লোভ আরক্তিম হয়ে ওঠে খোকার। এক-একটা প্রজাপতি উড়ে এসে আচমকা তাকে অন্য পথে ভুলিয়ে নিয়ে যায়; নানা রঙের ফুটফুটে ডোরাদার, কত কী। ফড়িংই-বা কত রকম—কোনগুলো টকটকে লাল, সমস্ত শরীরটা একটা পাকা ধানি লঙ্কার মতো চারটি ডানা—আভের তৈরি নিটোল নিখুঁত জিনিশের মতো—ভাঙে না, গুড়ো হয় না—ফড়িংটাকে মাঠের থেকে মাঠে—প্রাস্তরের এ পারে, দিগন্তে, নদীর ধারে, শশার খেতে, বাবলার জঙ্গলে, শ্মশানে কত জায়গায়ই যে নিয়ে যায়। ঘুরে ফিরে এই প্রজাপতি আর ফড়িংগুলো কানসোনার শিষে, দ্রোণ ফুলের ঝাড়ে, ঢেকি লতায়, আকন্দ ফুলে, ভেরেণ্ডাবনে এসে বসে, কিংবা লাউয়ের ডগায়, কিংবা বাঁশের মাচার একটা কঞ্চির উপরে। খোকা হয়তো এই সব দেখে দেখে হয়রান— একটা ফড়িংও ধরতে পারে না সে, তবুও হয়তো বর্ণচ্ছটাময় অজস্র প্রজাপতির জগৎ তার কাছে একটা সুন্দর সুদূর স্বপ্ন—সাম্পানচড়া মলয় নাবিকের চোখে দূর দক্ষিণ সমুদ্রের স্বপ্নের মতো তাকে এড়িয়েই চলে, দিন-রাত এড়িয়ে এড়িয়ে চলে—তারপর বিকেলের পড়ন্ত রোদের ভিতর দিয়ে সন্ধ্যার আবছায়া নেমে আসবার আগে কোনো পরীর রাজ্যে বিলীন হয়ে যায় সে। যাক। এই রকম বিলীন হয়ে যাওয়াই ভালো। একটা প্রজাপতি ধরে পাখনা ছিড়ে খোকার কী লাভ? তার চেয়ে এরা যদিন শিশুটিকে মাঠে পথে ভুলিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে বেড়ায় বেশ হয়; খোকাকে ধরা দেবে না কখনো—তার মনের ভিতর নিরবচ্ছিন্ন কল্পনা ও স্বপ্ন জাগিয়ে রাখবে; ভোরের থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে অনেক বহুরূপী রূপের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাবে—উঠানে, বাশবাগানে, চালতা তলায়, কিংবা লাল কুচ সবুজ তেলাকুচা লতার দেশে কিংবা আমের বোলগুলো যেখানে সবুজ কটা-ঘাসের ভিতর ঝরে শুকিয়ে মিষ্টি গন্ধ ছাড়ছে সেই রাজ্যে— অবাক নিস্তব্ধ হয়ে ভাবছিল প্রভাত। একটা পাতিলেবুর সবুজ পাতার উপর কমলা রঙের একটা প্রজাপতি—আজ এই দুপুরেই হয়তো খোকার কাছে তা জামশিদের মিনারের রাজ্যের চেয়ে ঢের বড় জিনিশ। তার নিজের কাছেও ওই রকমই মনে হত—খোকার বয়সে। পৃথিবীর সাধারণ হাঁটা-চলার পথ—তুচ্ছ খুঁটিনাটি যতদিন অনাবিষ্কারের বিস্ময়ে কুয়াশাভ হয়ে থাকে, ততদিনই খুব গভীরে লাভ—ধীরে ধীরে কল্পনা শুকিয়ে যায়—স্বপ্নগুলো যায় ভেঙেচুরে—বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি তৃপ্তি পাই না, শান্তি পাই না, জীবনটা একটা দাড়কাকের বাসার মতো ছন্নছাড়া জিনিশ হয়ে দাড়ায়; সকাল থেকে রাত্রি অদি একটা ক্ষুধিত কাকের মতো সমস্ত রকম কদৰ্যতা, চিত্তপ্রসাদহীন লালসা ও গ্লানির ভিতর নিবৃত্তি খুঁজে মরি, জীবনকে বুঝি জীবনধারণ বলে। প্রভাত মেসের বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করতে লাগল। আজকের গাড়িতেই Ꮌ Ꮌ ☾