পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সে দেশে চলে যাবে। যাওয়া যায় না ? ট্রেন ছাড়ে প্রায় বিকেল চারটের সময়—এখন বেজেছে দুটো। প্রভাত একটা চুরুট জুলিয়ে নিল। ঘন্টাদেড়েক সময় আছে আর। যাবে কি সে? আজই যাবে? কুলির মাথায় মোট চাপিয়ে হেঁটে চলে গেলেই হয়—সময় ঢের বাকি আছে গাড়ি ছাড়বার। কালকে কমলার একটা পোস্টকার্ড এসেছিল—তোশকের নীচের থেকে পোস্টকার্ডটা বের করল প্রভাত—প্রভাত যে দেশে যাবার সংকল্প করেছে এ তাদের কল্পনার ত্রিসীমানায়ও নেই; বরং অনুযোগ করে লিখেছে এতদিনেও কেন সে চাকরি জোগাড় করে উঠতে পারল না ? বিয়েই-বা করেছিল কেন ? ছেলেও তো হয়েছে দেখি? কী দিয়ে কী হয়? কে কোথায় দাঁড়ায়? চুরুটে এক টান দিয়ে পোস্টকার্ডটা রেখে দিল প্রভাত— চুরুটে এক টান দিয়ে ভাবল—পোস্টকার্ডে এ সব লেখা উচিত হয় নি কমলার। এটা তো একটা মেস—ত্রিশ-পয়ত্রিশ জন মানুষ থাকে। পিয়ন এসে চিঠিপত্র একটা ঢাকনা খোলা টিনের বাক্সে ফেলে দিয়ে যায়—যে খুশি যখন খুশি চিঠি নেড়েচেড়ে দেখে—কার্ড পড়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। একখানা খামে লিখতে পারত কমলা— যাক আজ আর যাওয়া হয় না। মেসের হিশেব মিটিয়ে দেওয়া হয় নি সমস্ত; খানিকটা বাকি আছে। ভাড়ার টাকারও জোগাড় নেই। খোকার জন্যও কিছু ছবির বই, খেলনা কেনা দরকার। খেলনা মানে ইঞ্জিন কিংবা মোটর—পুতুল নিয়ে তৃপ্তি থাকার বয়স পেরিয়ে গেছে সে, কমলার জন্যও অন্তত একখানা শাড়ি না নিলে চলে না—আর মায়ের জন্য একখানা গরদের চাদর। শেষ পর্যন্ত এত কিছু সে পারবে না বটে, মায়ের জন্য একখানা থান কাপড় আর কমলার জন্য একখানা সুতির শাড়ি আর খোকার জন্য একটা বেলুন—শেষ পর্যন্ত সম্ভার এইটুকুতে গিয়েই ঠেকবে হয়তো। প্রভাত চুরুটের থেকে খানিকটা ছাই ঝেড়ে ফেলল। তারাপদর কাছ থেকে গোটা পনেরো টাকা ধার করে আনবে সে। বড় লজ্জা করে। তারপদর সঙ্গে কলেজে একসাথে পড়েছিল সে—এক মেসেও ছিল অনেক দিন। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। স্ত্রী-সন্তান চাকরি-বাকরি ও ভাড়াটে ফ্ল্যাট নিয়ে সে আজ সফল মানুষ—প্রভাতের জীবন থেকে সে ঢের দূরে চলে গিয়েছে। ঘড়িতে তিনটা বাজল। না, আজ আর রওনা হওয়া যায় না, কলকাতা ছাড়বার আগে দাবি-দাওয়া মিটিয়ে রওনা হওয়াই ভালো, চোরের মতো পালিয়ে যাবে না সে । মেসের বাকি টাকা কটা বুঝিয়ে দিয়ে যাবে ম্যানেজারকে। দেশের বাড়িতে গিয়ে যখন উঠবে সেই মূহুর্তেই একেবারে ভিখিরির মতো আত্মবিক্রয় করে ফেলবে না সে; কয়েকটা অন্তত বেশ মহাজনের মতো বাহুল্য থাকবে তার—খোকাকে বেলুন দেবে, দেবে— মাকে থান, কমলাকে খন্দরের শাড়ি— কাগজটা তুললে সে। সকাল থেকেই বাড়ি যাওয়ার ঝোকে আছে—সেই থেকে এই আদি খবরের কাগজের একটা লাইনও তার মাথার ভিতর ঢোকে নি—কাগজটাকে নেড়েচেড়ে দলেমুচড়ে তছনছ করে রেখেছে সে। গুছিয়ে নিল। > >V)