পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্টেশনের ধারে এই শিমুল গাছটার বয়স ঢের। ছোটবেলার থেকেই দেখে এসেছে প্রভাত—দাড়কাক ঠুকরে ফুল ছিড়ত—ফুল পাকত—ফল শুকনো হয়ে ফেটে আকাশে বাতাসে তুলো ছড়াত; একদল ছেলেমেয়ের হাসি-ঝগড়া-কলরব এই ফুল ও তুলোর সঙ্গে কত দিন এসে মিশেছে যে! সে যে কবেকার কথা। পনেরো-কুড়ি বছর আগের একটা পৃথিবী প্রভাতের চোখের সামনে জেগে ওঠে, সেই পৃথিবী আজ মরে গেছে। সেই বালক-বালিকার ভিড় আজ নর-নারীত্বে পর্যবসিত—পৃথিবীর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে—শিমুলের ফুল ও তুলো আজ তাদের কাছে সবচেয়ে উপেক্ষার জিনিশ। কেন এ রকম হয় ? দিঘির পাড়ের অশ্বথের সবচেয়ে মোটা ডালগুলো তখন জন্মায়ও নি, কেওড় বাবলার বন কতবার পেকে গেছে তারপর, ঝরে গেছে কতবার, কত জল-মেটুলি সাপ মরে গেছে, কত পুকুর শুকিয়ে গেছে, কত শালিখ কোকিল অন্তহিত হয়েছে, বিশ্বস্তুরবাবুর শাদা গোফ জোড়া তখন কাচপোকার মতো নীল ছিল, গায়ে ছিল অসুরের মতো শক্তি—এখন তিনি চোখে দেখেন না, লাঠি ভর দিয়ে হঁটিতে হয়, সেদিন একটা ভেড়ার টু খেয়ে রাস্তায় গেলেন পড়ে— স্টিমারের সিড়ি বেয়ে-বেয়ে তারপর সেই জেটি—চটের বস্তার গুদাম—চট ও আলকাতরার গন্ধ সেখানে; কতদিন সে ঘ্ৰাণ পায় নি সে; আজ এই মেসের কামরায় বসে তা কত কাছের জিনিশ মনে হয়— জেটির থেকে বেরিয়ে তক্তার সিড়ি ধরে তারপর স্টেশনে লাল কাকরের রাস্তায়; রাস্তার দু’ধারে কৃষ্ণচুড়া আর ছাতিমের সারি; সবুজ ঘাসের উপর কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুলগুলো ছড়িয়ে থাকে; মস্ত বড় পল্লবিত ছাতার মত কৃষ্ণচূড়ার মাথাগুলো সবুজ পাতার নিবিড় ঘাসে নিরবচ্ছিন্ন রক্তিম ফুলের আভায় নীল আকাশের গায় খেলা করে; ছাতিম গাছের নীচে প্রতিবারই একদল নিরীহ ভেড়া ও ছাগলের ভিড় সে দেখে—এগুলো কার যে, জানে না সে। চুপচাপ বসে থাকে, ফুল খায়, ঘাস চিবোয়, প্রভাতের দিকে মুখ তুলে নিরপরাধ চোখের শান্ত অভ্যর্থনায় তাকায়। সেই ভেড়া ও ছাগলগুলোকে এবারও গিয়ে দেখতে পাবে না কি সে ? গতবারও দেখেছিল; তার আগে আরো কতবার দেখেছে যে সে। স্টেশনে ঘোড়ার গাড়ি ঢের; প্রভাতকে স্টিমার থেকে নামতে দেখলে ঝিলকান্দি রোডের আস্তাবলের গাড়োয়ান কালিম সবচেয়ে আগে ছুটে আসত; এবারও আসবে নিশ্চয়; মুখে তার ক্রমাগত—মহারাজ—হুজুর’, মহারাজ—হুজুর’। নিজের হাত দুটো জোড় করে অনবরত কচলাতে থাকে কালিম, কেন এলাম, কেমন আছি, দেশে কদিন থাকব—সে কত জিজ্ঞাসা তার। ঢের উচ্ছাস; প্রভাতদের বাড়ির সবাই যে ভালো আছে সে কথা আগারি জানিয়ে দেয় প্রভাতকে সে। শামশ রং—জোয়ান চেহারা—উডউীন বাজপাখির মতো দিব্যি চমৎকার মুসলমান যুবা; কালিমকে দেখলে মনটা খুব তৃপ্তি পায়— কিন্তু এবার আর গাড়িতে চড়া যাবে না; কালিমকে নিরাশ করতে হবে; পয়সা বড্ড কম; কুলির মাথায় মোট চাপিয়ে বাড়িতে যেতে হবে। চুরুটটা জ্বালাল প্রভাত। এক টান দিয়ে ভাবল সেই কুকুরটা বেঁচে আছে তো? বাবা তার নাম রেখে গিয়েছিলেন ‘কেতু—সেই থেকেই সববাই ‘কেতু ‘কেতু বলে ডাকে। বাবা আজ >>br