পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কারণ ছিল না তার; অবিশ্যি সমস্ত বাজারই মন্দা—সকলেরই দারিদ্র্য—জীবন্মত অবস্থায় মানুষকে বাঁচতে হয় : সেইই হয়তো তার বিক্ষোভের কারণ ছিল। এ জীবনে নিরঞ্জন কত পার্টই যে নিল, ছবছর বয়সে পালিয়ে গিয়ে যাত্রার দলে ঢুকল—ভালো গাইতে পারত বলে নবীন অধিকারীর দলে তার খুব আদর হয়েছিল—প্রভাতও লক্ষ্মণবর্জনে নিরঞ্জনের গান শুনেছে; সে প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা; কিন্তু আজও মনে হলে চুপচাপ নীরব হয়ে বসে থাকতে হয়, হয়তো আজই সে জিনিশের মূল্য সবচেয়ে বেশি। নিরঞ্জনের গানের গলা দু-তিন বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে গেল—অভিনয় সে করতে পারত না—যাত্রার দল থেকে তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিল—এরপর নিরঞ্জন অন্য এক অধিকারীর দলে জল টেনে, বাসন মেজে, কাপড় কেচে, পান বানিয়ে, তামাক সেজে ফোপর-দালালি করে বেড়াত। কিন্তু এ সব ভালো লাগল না তার। তবুও যাত্রার দলের গন্ধ সে সহজে ছাড়তে পারল না। কিছুদিন সে সিন আঁকতে চেষ্টা করল। কিন্তু সে তার জীবনের সবচেয়ে নিরেট ব্যর্থতা। নিজে একটা যাত্রার দল খুলবে বলে ঠিক করল—কিন্তু অতিরিক্ত মোড়লি করতে গিয়ে পণ্ড হয়ে গেল সব। একবার প্রভাত শুনল—নিরঞ্জন কলকাতায় পালিয়ে গেছে। প্রভাত তখন ইস্কুলে পড়ে। কলকাতার থেকে যারা আসে তারা খবর দেয়, নিরঞ্জন থিয়েটারে ঢুকেছে। কলকাতা শহরে খুব নাম করে ফেলেছে সে; আধাআধি কলকাতার বাসিন্দা তাকে চিনে নিয়েছে। একদিন হঠাৎ ইস্কুলে যাবার পথে নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা—পরনে একটা কপাসডাঙার চুড়ি পাড়ের কাপড়—গায়ে গলাবন্ধ আলপাকার কোট—পায়ে নিউ কাট (?)—বার্ডসাই মুখে। নিরঞ্জন খুব চাল দিল না কলকাতার; প্রভাতকে খুব খাতির করল—বার্ডসাই সাধল—বললে, ‘লেখাপড়া না করলে মানুষ হতে পারা যায় না—বাস্তবিক। —ইস্কুলে কোন ক্লাসে কী রকম মাইনে দিতে হয় জিজ্ঞেস করল, যে-ক্লাসে সবচেয়ে কম মায়না সেই ক্লাসেই ভর্তি হবে বলল; প্রভাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি ভর্তি হবে একটা পাড়া-গায়ের ইস্কুলে—কলকাতায় তোমার এত নাম!’ নিরঞ্জন মাথা নেড়ে হেসে বললে—‘না, ও ঠাট্টা করছিলাম—এখানে একটা এ্যামেচার থিয়েটার কোম্পানি খুলব ভাবচি। এ্যামেচার কথাটির মানে তখন জানত না প্রভাত—অবাক হয়ে নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল : নিরঞ্জন কলকাতায় গিয়ে ইংরেজিও শিখে ফেলেছে ঢের । ইস্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে একটা খেজুর গাছের আড়ালে দুজন গিয়ে দাঁড়াল। প্রভাত বললে—‘বাঃ, কলকাতায় এত নামগাম করে এসে পাড়াগায়ে থিয়েটার খুলবে? এ আবার কী ছাই?’ নিরঞ্জন সিগারেটে একটা Y টান দিয়ে বলেছিল—‘দূর! তোমার সঙ্গে একটু মশকরা করলাম। এখানে আমার এজেন্ট রেখে দেব। আমার নিজের থিয়েটার থাকবে কলকাতায়।’ কয়েক দিন পরে ইস্কুল থেকে ফিরবার পথে প্রভাত দেখল পিঠে এক বস্তা নিয়ে চলেছে নিরঞ্জন— > २०