পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

না। এম.এ পাশ করে কলেজের থেকে বেরিয়ে কন্টিনেন্টের ঢের বই পড়ল সে.কিন্তু ডিকেন্স অস্পৃশ্য হয়ে রইল। আজ এই ত্রিশ বছর বয়সে ডিকেন্সের একখানা বইও তার পড়া নেই। ব্যাপারটা হয়তো বিশেষ লজ্জার কিছু নয়.কিন্তু এক-একবার প্রভাত অবাক হয়ে ভাবে বাবা অত সাধ করে ডিকেন্সের সমস্ত বইগুলো কিনলেন, পড়লেন, প্রাজ্ঞের মতো অজড় অমর সংস্থিতি নিয়ে ডিকেন্সকে করেছিলেন যেন তিনি তার খাদ্য—কথাবার্তায় অনেক সময়ই ডিকেন্সের গল্প পাড়তেন। এ-রকম কেন? বইগুলো না পড়া পর্যন্ত কেমন যেন একটা কুত্ত্বটিকা কৌতুহল ডানা বিস্তৃতিকে দাবিয়ে রাখে। দেশের বাড়িতে গিয়ে এ কৌতুহল তৃপ্ত করতে হবে এবার ডিকেন্সের অতগুলো বই, উই আরশোলা ও চুরি-চামারির হাত থেকে বেঁচেছে, খুব স্থির নিরপেক্ষ বিচার এই বইগুলো নিয়ে কয়েকটা দুপুর বেশ ভরসার সঙ্গে কাটবে আশা করা যায়— সন্ধ্যা হয়ে গেল বিছানার উপর শুয়ে পড়ে চুরুটটা ফুকে-ফুকে শেষ করতে রাত হয়ে যায়; তারাপদর কাছে আজ আর যাওয়া হল না।

  • i-o-o

পরদিন সকালবেলা তারাপদ কুড়িটা টাকা দিল—মেসের ম্যানেজার আট টাকা পায়, থার্ড ক্লাসের একটা টিকিটের জন্য সাড়ে চার টাকা রেখে বাকি টাকাগুলো দিয়ে প্রভাত একটা থান কাপড়, সুতির শাড়ি ও লাটিম বেলুন, ছবির বই কিনে নিল। ধার করার আগে হাতে তিন টাকা সোয়া ন আনা ছিল—টিকিট কেটেও তাহলে পাঁচ-ছয় টাকা হাতে থাকে—প্রভাত কলেজ স্ট্রিটের ওয়াই-এম-সি-এতে ঢুকে পাঁচ পয়সা দিয়ে চা খেল। ছোট এক কেটলি ভরা চা...প্রায় দু কাপ আন্দাজ হল—বেশ চা খেতে-খেতে অনেকক্ষণ ফ্যানের নীচে নিস্তব্ধ হয়ে বসে থেকে এই বিরাট পৃথিবীর জীবন ব্যাপারে চরিতার্থ একজন সার্থক জীব বলে মনে হতে লাগল নিজেকে। কয়েকটা দামি চুরুট কেনা যায়; কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে গিয়ে একবার বসে, অশ্বথ-দেবদারুর দিকে তাকিয়ে দেখে, দিঘির চার কিনার ঘিরে মরশুমি ফুলের গাছগুলো ঢের বড় হয়ে উঠেছে—ফুলের সম্ভার ঢের তো এবার—বিমুগ্ধ হয়ে উপলব্ধি করে নেয়। একটা চুরুট জ্বালায়, ছটা-ছটা মেহেদি গাছের ডালপালার ভিতর চড়াই না কি—তাকিয়ে দেখে একবার—দিঘির পুব-দক্ষিণ কোণে নারকেল গাছটাকে জড়িয়ে জড়িয়ে লতাটা বেশ নিবিড় হয়ে উঠেছে এদিনে—কিন্তু দেশের পথেঘাটে এ রকম কত লতা, কত ঝুমকো ফুল! সুইমিং ক্লাবের ছেলেরা ওয়াটার পোলো খেলছে। একটি ভদ্রলোক, তার স্ত্রী ও দুই-তিনটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটা বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে; ভদ্রলোকের মাথায় ছাতা, স্ত্রীর মাথায় ঘোমটা, ছেলেমেয়েদের মাথায় বাদর টুপি। কলকাতায় এরই নাম বোধ হয় মুক্তবাতাস সেবন। আকাশ বাতাস আলোরৌদ্র যেন এখানে লিমিটেড কোম্পানির জিনিশ; কাদের বেশি শেয়ার—বড় বড় ডিভিডেন্ড টানে, বিধাতা জানেন—বিধাতা একাই টানেন হয়তো—কেমন একটা চিমসে দরিদ্রতা ধরা পড়ে যেন এখানে—ভাবতে গেলে দম আটকে আসে যেন—আর তিন-চারদিন পর পাড়াগার মাঠপ্রান্তরের গভীর দাক্ষিণ্যের ভিতর হাটতে-হাটতে কলকাতার রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি ও জীবনের নিয়ম, অবাঞ্ছিত অনিয়মের রুদ্ধশ্বাস বলে মনে হবে তার কাছে— Տ Հ(է