পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবদারু নর্মর করে ওঠে। অশ্বথের ভিতর দিয়ে ল্যাজঝোলা পাখির মতো হুহু করে দক্ষিণের বাতাস উড়ে যায়—ডালপালা নড়ে—বুলবুলির পাখনা কেঁপে ওঠে—হলদে শুকনো পাতা বেঞ্চির চারদিকে ছড়াতে থাকে—বাতাসের তাড়ায় সূর্যমুখীগুলো প্রভাতের দিকে চোখ ফিরিয়ে কাপতে থাকে— কয়েকটা মিনিট কেমন একটু বিহবল হয়ে বেঞ্চিতে বসে থাকতে হয়; কিন্তু ভাবটা কেটে যায় শিগগিরই। সুইমিং ক্লাবের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে হয়। আজই বাড়ি যেতে হবে যে তাকে। সব ঠিকঠাক করে তিনটার সময়ই স্টেশনে পৌছুনো চাই। মেসে গিয়ে দেখল কমলার একটা কার্ড এসেছে। বউয়ের চিঠির সুর লড়াইবাজ রক্তাক্ত চিলবধূর মতো যেন—নিজেকেও সে ছিড়ে খেতে পারলে বাচে; আশাস্বপ্নসমাকুল মেঠো ইদুরের জীবনেও এক মুহুর্তের শান্তি (ফুরিয়ে যায় যেন)। মেসের কামরার ভিতর ঢুকে হাতের বস্তাটা বিছানার এক পাশে ফেলে দিয়ে প্রভাত অবসন্ন হয়ে শুয়ে পড়ল। নাঃ—দেশে যাওয়া আর হবে না, গিয়ে করবে কী সে ? পরদিন সকালবেলা নিজেকে বড্ড বোকা মনে হল; একটা দিন মিছিমিছি মাটি করেছে সে। কমলা যা খুশি তা লিখুক গিয়ে কিন্তু দেশ তো কমলার নয়; মা রয়েছেন—কেতু কুকুরটা আছে—নিরঞ্জন আছে—খোকা আছে—শ্মশানে বাবার ইশারা রয়েছে—পথেঘাটে কত চেনা লোক—বাড়ির পুবদিকের অশ্বখ গাছটা— প্রভাত সকালবেলাই তার জিনিশপত্র গুছিয়ে ঠিকঠাক করে রাখল; বাকি শুধু বিছানা বাধা, খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু গড়িয়ে নিয়ে বেডিংটা বেঁধে ফেলবে সে—আড়াইটার সময় স্টেশনের দিকে রওনা দেবে। আর বেরুল না কোথাও সে । চায়ের দোকানে আদি গেল না। চাকরকে দিয়ে বাইরে থেকেই চা আনিয়ে নিল। বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজটা অনেকক্ষণ ধরে পড়ছিল—হঠাৎ পায়ের শব্দে কাগজ সরিয়ে তাকিয়ে দেখল—চশমা চোখে একটি ছেলে এসে তার চৌকির কাছে দাড়িয়েছে। প্রভাত—আপনি কাকে চান ? —আপনি কি প্রভাতবাবু? —‘হ্যা।’ —‘কার্তিকবাবুকে আপনি চেনেন? —‘চিনি।’ ছেলেটি প্রভাতের চৌকির উপর বসে। —“আমি থার্ড ইয়ারে পড়ি, তিনি আমাকে পড়াতেন, কয়েক দিন হল দেশে গিয়েছেন, মাস তিনেকের ভিতর বোধ হয় ফিরবেন না আর। সামারটা দেশেই কাটাবেন—’ ছেলেটি একটু চুপ করে বললে—তা আপনার ঠিকানা দিয়ে গেলেন আমার কাছে। বললেন যে আপনি খালাশ মানুষ আছেন—টিউশন খুঁজছেন—পড়ানোর অভ্যাস-টভ্যাস আছে আপনার— ১২৬