পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জিনিশ হয়ে দাড়াবে—খোকা তা প্রত্যাশাও করবে না; বাপও লজ্জিত হবে—ছেলে নিজেই লজ্জা পাবে সবার চেয়ে ঢের রেশি! আদর করতে গেলে এড়িয়ে যাবে, ছুটে পালিয়ে যাবে ছেলেটি। আদর করবেই-বা কী—সেই নরম বিচিত্র হাতপা-ই-বা কোথায় খোকার—সেই রেশমের মতো চুল—টুলটুলে গাল—কোথায় গেল সে সব ? খোকার জীবনের কে এমন ভয়াবহ মুগুচ্ছেদ করল ? প্রভাতের কোনো অনুমতির জন্যও অপেক্ষা করল না? মানুষের জীবনের গতি বড় তীব্র : কমলার মুখও হয়তো এতদিনে থুবড়ে পড়েছে— মা-ও না জানি কতখানি বুড়ো হয়ে গেছেন— সমস্ত রাত মেসের বিছানায় শুয়ে থেকে একটার পর আর একটা কথা ভাবতে লাগল প্রভাত। একটা কথাও মানুষকে ভরসা দেয় না—কেমন করে তোলে— পরদিন সকালবেলা কিছুতেই আর উঠতে পারা যায় না যেন— সমস্ত শরীর পুড়ে যাচ্ছে—গায়ে কেমন অসহ্য ব্যথা— কিন্তু তবুও ইস্কুলের বেলা হতে না হতেই উঠে বসল প্রভাত; কিছু না খেয়েই বাসে করে ইস্কুলে চলে গেল। প্রথম দুই ঘণ্টা ককাতে-ককাতে পড়িয়ে নিজেকে কেমন অমানুষ বলে বোধ হতে লাগল প্রভাতের—নিজের উপর এ কী অত্যাচার তার। মানুষ কি ইস্কুল মাস্টারি করবার জন্যই বেঁচে থাকে না কি? ঘণ্টা বাজাতেই হেডমাস্টারের কাছে গিয়ে ছুটি চাইল সে। হেডমাস্টার—আপনার টেম্পোরারি কাজ, দুঘণ্টা পড়িয়েই ছুটি? কেন, কী হল আপনার ?” —বড্ড অসুখ করেছে।’ —‘অসুখ তো করবেই—আমাদের লোক বড্ড কম—এখনই তো অসুখের সময়—অসুখ না করলে চলে। এত কাজ করে কে? প্রভাত দাড়াতে পারছিল না। হেডমাস্টার—‘কী আর করা; যান—অসুখ যখন করেছে—কাল দু-এক ঘণ্টা বেশি পড়িয়ে দেবেন বরং। মেসে ফিরে এসে প্রভাত ঠিক করল আজই সে দেশে চলে যাবে। বাক্স বিছানা গোছাতে গোছাতে প্রভাত ভাবল মানুষ যদি এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে তা হলে জীবন তাকে মনে করে অপদার্থ শব, সময় আসে শকুনের মতো উড়ে, তাই আসে—তাই আসে। এ পাঁচ বছর ধরে কী করে এত অসতর্ক—অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল সে—জীবনের হাতে এত প্রতারণা সহ্য করল। এত অসম্ভব অদ্ভুত ব্যাপার কী করে যে ঘটে। কিন্তু এই সৃষ্টি যার কাছে আঁতুড় ঘরের জননীর মতো মমতা প্রত্যাশা করা অসম্ভব, যা অন্ধ অবসাদে চলে—অন্ধকারে ভাঙা সর্পিল সেতুর মতো—নিঃসহায়তার নির্মমতায় করে অপপ্রয়োগ, নিরবচ্ছিন্ন অপচেষ্টায় শানিয়ে ওঠে। বিছানা বাধতে-বাঁধতে প্রভাত ভাবল—মানুষ ক-দিনই বা বাচে, বাচে না বেশিদিন। টাকাকড়ি সফলতাও খুব কম মানুষের জীবনেই হয়। কিন্তু কয়েকটা ভালোবাসার জিনিশ আমাদের জন্য সে রেখে দেয়। সে সবের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকে লাভ কী? অন্ধকার সেই অসংস্থিতি, খেয়াল যার এত অন্ধ, সে কখন কী কঠিনতা করে বসে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? > ○8