পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ওঃ, দু আনা বুঝি ? দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ; কল্যাণী সেলাই করছিল, আমি বই ঝাড়ছিলাম, মুছছিলাম, পাতা উলটাচ্ছিলাম—কিন্তু দু আনা পয়সার সম্বল আজ আমার কাছে নেই। এবং আমার বয়স চৌত্ৰিশ, বারো বছর আগে এম-এ পাশ করেছিলাম বটে, বিয়ের আগে দু-তিনটে কলেজে অস্থায়ী কাজ করেছি—আরো অনেক কাজ করেছি; কিন্তু সংসার ও সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষদের জীবনের পদ্ধতির সঙ্গে কোথাও না কোথাও সম্পূর্ণ ভিন্নতা ও জটিলতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি আমি। কাজেই এম-এ ডিগ্রি ও স্ত্রী সস্তান সত্ত্বেও এই চৌত্রিশ বছর বয়সে আজও আমি সংসারী হয়ে উঠতে পারলাম না, আক্ষেপের কথা হয়তো। কিংবা আক্ষেপের কথাই বা কেন আর ? জীবন তো শুধু স্ত্রী-সন্তান নিয়েই নয়। বিকেলের ধূসরতার ভিতর যখন সবুজ ঘাসের মাঠের পথে হাটতে থাকি, কিংবা হেমন্তের সন্ধ্যায় চড়ুই-শালিখ যখন উড়ে চলে গেছে, দিকে-দিকে কুয়াশা জমে ওঠে, লক্ষ্মীপুজোর ধূপের ভিতরেও যখন গন্ধ, কিংবা আরো গভীর রাতে অশ্বথের ডালপালা যখন জ্যোৎস্নার বাতাসে ঝিরঝির করে, কতবিহঙ্গম-বিহঙ্গমার নীড় বুকে নিয়ে বিরাট বটগাছ দাঁড়িয়ে থাকে, বটের নীচে উপকথার পথিক গিয়ে দাঁড়ায়—এক মুহুর্তের ভিতরেই সমস্ত অতীত ও ভবিষ্যতের প্রেম, স্বপ্ন ও সফলতার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক অন্ধকারের পথে অবিরাম চলতে ইচ্ছা করে। সংসারের সঙ্গে সম্পর্কহীন—জীবনের এই আর-এক রূপ। এই রূপের পথে চলতে-চলতে কিশোর বেলার নষ্ট প্রেমের বেদনা ও লাঞ্ছনা ভুলতে চেয়েছিলাম, আজকের সংসারের ক্ষয় ও ক্ষতি নিয়ে আক্ষেপ করব ? অবিশ্যি বাবার কাছে চাইলে দু আনা পয়সা পাওয়া যায়। দু আনা চাইলে তিনি হয়তো চার আনাও দিয়ে দেবেন। আমি মুখ ফুটে বড় একটা চাই না কি-না। সেই জন্য, চাইলেই, তিনি যতদূর সম্ভব দিয়ে দেন। অবিলম্বে অকাতরে আমার কলকাতার খাওয়ার খরচও তিনিই জোগাড় করে দেবেন; তারপর দাদাকে বেরিলিতে লিখে দেবেন আমার কলকাতার মেসের খরচটা কিছু দিন চালাতে—যে পর্যন্ত না আমি ট্যুইশান পাই। আমি ট্যুইশান পাই বা না পাই, আমি কলকাতায় এলেই দাদা একটা মাস মেসের খরচ দেন; তারপর বন্ধ করে দেন—শত অনুনয়-অনুরোধ করলেও কিছুই গ্রাহ্য করেন না, আমার টিকিটের পয়সা খরচ হয় শুধু; কাজেই অনুরোধ করে চিঠি লিখতে যাই না, এক মাসের টাকা দিয়ে তিন মাস চালাতে চেষ্টা করি—দেশের বাড়িতে খরচ যেন তিনি বন্ধ না করেন, ভবিতব্যের কাছে এই প্রার্থনা করি। বাবা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন বন্ধ করবেন না, কিন্তু বাবা চলে গেলে পর ? জীবন যদি তখনো আমার এই পথে চলে ? কিন্তু কেনই-বা চলবে? ভবিষ্যতের জন্য আশা করা যাক। না হয়, চরকায় সুতো কেটে কাপড়ের ব্যবস্থা করব, যেটুকু জমি আছে তাতে লাউ-কুমড়ো-বেগুন-মরিচের গাছ লাগিয়ে দেব; আর চাল ? ভাবছিলাম। কল্যাণী—“খুব বেশি নেয় তো তা হলে ? ‘কে বেশি নেয়, কল্যাণী ? \లి