পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যতক্ষণে আমি পাতা দশেক পড়ে উঠতে পারি ততক্ষণে বাবার পঞ্চাশ পাতা হয়ে যায়। ঘেষাৰ্ঘেষি হয়, কথাবার্তা ফুরুতে চায় না, কাজ জমে ওঠে, কাজ নিকাশ হয়। সমস্ত বলে মনে হয় শুধু। তারপর দেশের বাড়িতে এক-একবার চলে যাই। মা কাছে এসে বসেন, চারদিককার খবর জানাতে থাকেন, যত বলি তার চেয়ে ঢের বেশি গল্প শুনি। নীলিমা আসে, কথাবার্তা চলে, মনে হয়, আবার যেন শিশুর মতো কোনো এক আদিকালে এসেছি। চারদিকে নরম অন্ধকার, খাপরার আগুনের স্নিগ্ধ আঁচ, মুখে মধু, প্রাণের ভিতর আশাসাহস, জীবনের সাধ-স্বপ্ন আগ্রহ কলরব। মানুষের জীবনের আগ্রহ ও আস্বাদ অনেক দিন পরে ঐকান্তিক হয়ে জমে ওঠে আবার । এক-একবার দুপুরবেলা জানালার কাছে লেবু ফুলের গন্ধমাখা বাতাসের ভিতর বসে দিনান্তের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এই মাঠ-প্রান্তর, দুপুরবেলার তারুণ্য-দীপ্ত রোদের স্ফূর্তি ও নির্জন গন্ধ, চারদিককার শুকনো বাদামি খড়, শব্দ, নীল আকাশের নীচে শাদা সজনে ফুলের রাশি, বাসস্তী, কমলা, হলদে ও পাটকিলে রঙের প্রজাপতিগুলো, ময়না কাটার ঝোপে অক্লান্ত ফড়িং, তেলাকুচোর জঙ্গলে লাল মাকাল ফলের মোহে টিয়ার ডানার ছড়াছড়ি, খড়ের চালের উপরে শূন্য আকাশে আচমকা মাছরাঙার চিৎকার। মাঠের ভিতর গোসাপ দেখে শালিকগুলোর উত্তেজিত কলরব, সারা দুপুর দুটো বেজির অক্লান্ত খুনসুড়ি, কামিনী গাছের ভিতর সারা দিন টুনটুনিদের লাফালাফি ব্যাপার্কাপি, মাঠের এক কিনারে পুরোনো ইটের পাজা ঘিরে শাদা লাল দ্ৰোণ ফুল, মনে হয় প্রাণের তৃপ্তির পক্ষে এইগুলোই যথেষ্ট। মানুষের কোনো দরকার নেই আর। নীলিমা চলে যেতে পারে, মাকে দিয়ে কোনো প্রয়োজন নেই। এই সমস্ত ঘর-দোর যদি প্রাণীহীন হয়ে পড়ে থাকে তা হলেও দেশের বাড়ির এই মাঠ-প্রান্তরের আস্বাদ, জোনাকি-জুলা সন্ধ্যা, ভুতুম পেচার ডাকে-ভরা রহস্যময় রাত, পথপ্রান্ত, মানব-আত্মাকে অনেক দিন পর্যন্ত নিবিষ্ট করে রাখতে পারে। কিন্তু তবুও দেশে যাচ্ছি এবার মানুষ কটির জন্যই। বাবার জন্য অনেকগুলো নতুন নভেল নিয়েছি। হুইলারের নভেলই প্রায়—কিন্তু নামজাদা ইংরেজি উপন্যাসও প্রায় আট-দশ খানা আছে। এবার আমার হাতে ঢের প্রমাণ আছে যে মৃত্যুর পর মানুষের কপালে শ্মশানের ছাই, হাড় ও অন্ধকার ছাড়া আর-কিছু নেই; শুনে বাবা হয়তো খুব কঠিন ভাবে ঠেকে বসবেন। কিন্তু কয়েক মুহুর্তের জন্য; কিন্তু তার পরেই আমায় অন্তরীক্ষে ক্ষমা করে যুক্তির অবতারণা করবেন; ক্ৰমে-ক্রমে বলবেন যুক্তি-তর্কে কিছু হয় না, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা চাই। তবুও অনেক দূর পর্যন্ত তর্ক করেন তিনি, অনেক জানেন, ঢের দৃষ্টান্ত আছে যাতে মাঝে-মাঝে তার মনের পরিষ্কার উজ্জ্বলতা দেখে আশ্চর্য হতে হয়, অনেক রাত পর্যন্ত কথাবার্তা জমে বেশ। এই দেড় বছরের মধ্যে এ-পাড়ার ও-পাড়ার খবর ঢের জমে গেছে মা-র কাছে; S 88