পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংসারকে ভরে দিয়েছে ছাই কালি-ধূলির শূন্যতায়। যে-উদ্যম ও আকাঙ্ক্ষার নিঃসঙ্কোচ সাংসারিকতা ও স্বাভাবিকতা স্বরাজ পার্টি গঠন করতে পারত, কিংবা কংগ্রেস, অথবা একটা মোটর কার, কিংবা একটা নামজাদা বই, বা চায়ের দোকান, অথবা একজন অক্লান্ত কমী চেয়ারম্যানকে তৈরি করতে পারে, অসীম অধ্যাবসায়ী উকিলকে, কিংবা সচ্চরিত্র হেড মাস্টারকে, মুচিকে, মিস্ত্রিকে সেই ] আকাঙক্ষা-উদ্যম নেই আমার। আকাঙক্ষা ও উদ্যমের অকুতোভয় স্বাভাবিকতা ও অমিততেজা সাংসারিকতা যদি থাকত তা হলে গত ছ-সাত বছরের মধ্যে কোনো-না-কোনো কাজ আমি নিশ্চয়ই খুঁজে পেতাম; হয়তো কোনো ইস্কুলে পচিশ টাকার মাস্টারি নিতাম, কোনো মেসের সরকার হয়ে যেতাম হয়তো, লাইফ ইনসিওরেন্সের এজেন্সি নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে একদিনে হয়তো প্রদীপ জুলিয়ে ফেলতে পারতাম, দর্জির কাজ শিখে ফেলতাম কিংবা স্টেনোগ্রাফার হয়ে যেতাম, নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতায় ক্যানভাস করতাম হয়তো, কিংবা কিংবা দু-তিন গ্রুপে এম-এ নিয়ে ফেলতাম, হয়তো নিদারুণ একনিষ্ঠতার সঙ্গে জেলে পচতাম, কিংবা লুক্ষেপহীন অক্লাস্তিতে পথে-পথে জুতো সেলাই করে চলতাম। আলুর আড়ৎ না-খুলে সাহিত্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছি বলে মনের ভিতর কোনো বেদনা থাকত না। যদি আমি বিবাহ না করতাম, সস্তান না হত আমার, যদি একা থাকতাম আমি—তা হলেও শিল্পসৃষ্টি ভালোবেসে, সংসারে বিফল হয়ে, মনের ভিতর কোনো নিরবচ্ছিন্ন বেদনা থাকত না। হয়তো খুব লঘু ভাবে থাকত। কিন্তু কল্যাণী ও খুকির ভার এমন একজনের উপর পড়েছে, যে, না-পারে ঐকান্তিক ভাবে শেয়ার ক্যানভাস করে বেড়াতে, না-পারে ঘোলের শরবতের দোকান খুলে লক্ষ্মীকে অধিকার করবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাতে । সমস্ত কারুতান্ত্রিকই কি সংসারের স্ত্রীর প্রতি এমন বিরাটভাবে উদাসীন। তা ঠিক নয়; শিল্পযাত্রীও শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মানুষ হিশেবেই রক্তমাংসের সুখসুবিধা সুব্যবস্থা চায় বইকি, কিন্তু তার জীবনের মধ্যে প্রেরণার ভিতর নিরবয়বকে উপলব্ধি করে আনন্দ, ও অবয়বসম্পৃক্ত নিষ্ফলতা, আবহমানকাল থেকে এই মধুর মারাত্মক বীজ রয়ে গেছে। একখানা গল্পের বইয়ের সাংসারিক দাম যে তেমন কিছু নয়, একখানা কবিতার বইয়ের দাম যে আরো ঢের কম তা তাকে বারবার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সংসার; কিন্তু তবুও সমস্ত কবিতা ও র প্রেরণা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে সংসারের ছককাটা উন্নতির পথে পরিপূর্ণ করবার মতো স্বাভাবিকতা কোনোদিনই সে অর্জন করতে পারে না। এমনই অস্বাভাবিক অবৈধ মানুষ সে, এই আর্টিস্ট। চণ্ডীদাস একজন, ভিলোঁ আর-একজন, হাইনে একজন, আর-একজন ভারতচন্দ্র। না-খেতে পেয়ে মরেছে, কিংবা যক্ষ্মায়, কিংবা লাঞ্ছিত হয়ে, কিংবা দুর্দিনের তিমিরে স্বল্পতায় । কিন্তু তবুও শিল্পীর জীবনের নিদারুণ ভবিতব্যতার পথ থেকে সংসারের যক্ষের শান্তিনিকেতনে পালিয়ে যেতে চায় নি, যেতে পারে নি, কেউ কোনোদিনও পারে নি, কোনোদিনও পারবে না। ৩৯