পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

—“কোথায় বেলাতে ?” —‘এই গাছে-গাছে, মাঠে-মাঠে। চুপ করে ভাবছিল। খানিকক্ষণ পরে—আমি মাঠে যাব।’ —“কাল সকালে যেও’ —'ভুলুর সঙ্গে খেলা কলব না? —‘হ্যা।’ —নন্দু আসবে, রবি আসবে...’ তেঁতুল গাছের ভিতর থেকে বক ডেকে উঠল, ঘরের পাশের মস্তবড় পেয়ারা গাছের নিবিড় ডালপালার উপর গোটা দুই বাদুড় বঁপিয়ে পড়ল, ঝাড়া খেয়ে খানিকটা শিশির না বৃষ্টি পড়ার শব্দ—খুকুর চোখে ঘুম নেই, পৃথিবীর সমস্ত গন্ধ, রস, স্মৃতি ও শব্দের দিকে হৃদয় রয়েছে যেন জেগে—আজ ওর বেশি জ্বর নেই। খুকু পাশ ফিরে শুল একবার—পচিশ বছরের পুরোনো কাঠালের খুঁটিটার দিকে তাকিয়ে। ধীরে-ধীরে শিরদাঁড়ায় আঙুল বুলুচ্ছিলাম—একটা টিকটিকির মতো মেরুদণ্ডে যেন—শুকনো বঁাশপাতার মতো চিমসে শরীর। মা আছে, বাবা আছে, দাদু আছে, ঠাকুরমা আছে তবুও যেন মনে হয়, ঠিকানাহীন নিরুদ্দেশ রুগণ একটা বিড়ালের ছানার মতো, ক্ষমাহীন পৃথিবীর পথে-বিপথে, এটাে ও ঝাটা খেয়ে বেড়াবার জন্য এর জন্ম ও জীবন। মেসে যখন থাকি—দুপুর বেলা সমস্ত মেস নির্জন—বিছানায় বসে বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখি, দু-একটা চড়ই নিঃশব্দে লাফিয়ে-লাফিয়ে সমস্ত বারান্দা ঘুরে দু-এক টুকরো খুদের সন্ধানে ফিরছে; এর ভিতর বেদনার তো কিছু নেই; কিন্তু তবুও মনে আঘাত লাগে যেন কেমন, আমার মেয়েটির কথা মনে হয়, চড়াইয়ের ছোট্ট নিঃসহায় মুখ, করুণ ঠ্যাং, অসম্পূর্ণ অকৃতকার্য দৃষ্টি ঘুরেফিরে একটি আড়াই বছরের শিশুর রূপ মনে জাগায়। খুকি যখন দেশের বাড়িতে জন্মেছিল, তখনো আমি কলকাতার মেসে ছিলাম। দিনের পর দিন ভয়ে, সন্দেহে, বিক্ষুব্ধতায়, পৃথিবীতে এই শিশুটির আগমন প্রতীক্ষা করছিলাম। কে জানে, সে হয়তো মৃত হয়ে জন্মাবে; কিংবা তার জীবনের বিনিময়ে জননীকে মৃত্যুর দায় দিতে হবে ? কে জানে, অন্ধ হয়ে জন্মাবে, হয়তো এই শিশু ? কিংবা অঙ্গহীন হয়ে ? হয়তো মূকবধির হবে? কিংবা অত্যন্ত অজ্ঞান জড়ের মন নিয়ে পৃথিবীতে আজন্মকাল নিজেকে পরিহাস করে চলে যাবে? হয়তো, মৃত হয়ে জন্মালেই ভালো। পিতার হৃদয়ের এই রকম অনেক বিবর্ণ হতাশ অমঙ্গল চিস্তার মধ্যে এর জন্ম। গর্ভে যখন ছিল এই মেয়েটি এর মায়ের হৃদয় তখন বর্ণহীন রূপহীন শাদা করবীর একটা শাখার মতো, হেমন্তের সন্ধ্যার কুয়াশা ওদিকে তাকিয়ে আছে। গর্ভজাত শিশুর জীবন সম্বন্ধে আশা খুব কম ছিল ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম সন্তান প্রসবের পর একটা টেলিগ্রাম আসবে, আসতও, কিন্তু মেয়ে হয়েছে বলে বাড়ির লোকেরা টেলিগ্রাম করলে না আর। বিলম্ব করে, অবহেলা করে একখানা পোস্টকার্ড লিখে সংবাদটা জানাল আমাকে। টিকটিকির মতো মেরুদণ্ডসার এই মেয়েটি বিধাতা ও মানুষের এতই উপেক্ষার জিনিশ ? সুস্থ, সুগোল, সুন্দর শিশুকেই শুধু সম্ভব করতে হবে—আদর а о