পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

—যাই।’ — কোথায় ?” —লুচি করতে হবে। তোমার মেজকাকার জন্য।’ —তা এত তাড়া কী? এখন তো মোটে দুটো। —উদ্যোগ করতে হবে তো। —‘না হয় একটু দেরিই হয়ে গেল আজ; বলো হেমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটু বিলম্ব হয়ে গেল; কিছু বলবেন না তিনি। —না, আমার একটু এখন দক্ষিণের ঘরে যেতে হবে। —‘কেন ?" —“তোমার মেজকাকা বলেন, দুপুরটা বড্ড একা লাগে।’ —তাই না কি?’ —সান্নিধ্য তিনি বড় একটা ভালোবাসেন না।’ —পিসিমা ওখানে আছেন ?? —হা আছে। ওর বকবকানি মেজবাবুর চক্ষুশূল। —'মেজকাকা জেগে আছেন এখনো ?” —আছেন বইকি; সারা দুপুরই কি মানুষ ঘুমোয় ? —‘কী করেন সমস্তটা দুপুরবেলা? —'কাই-বা করবেন, তাই তো বলছিলেন, বডড একা লাগে, সময় কাটতে চায় না; তুমি এসো বড়বউ। —‘বাবা তোমাকে বড়বউ বলে ডাকেন না ? মা একটা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। —“কিংবা কাছে এসে বসতেও বলেন না ?’ —’বুড়ো বয়সে কাণ্ডজ্ঞান হারান নি তো’— —ইস্কুল থেকে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেন, খুকিকে আদর করেন, কোলে নেন, খুকির সঙ্গে খেলা করেন, কিন্তু তবুও যেন কেমন একটা অভাব ঘুচতে চায় না, বুঝি অনেক কথা বলবার আছে তার, তিনি অনেক বিনিময়ের মানুষ, আমার কাছে সমস্ত কথা ব্যক্ত করবার তার সুযোগ নেই—অধিকার নেই, নির্দেশ নেই। আর্টিস্ট নন তিনি, লিখে নিজেকে নির্মুক্ত করে নেবার অবসর নেই। সামাজিক লোক নন, বন্ধু-বান্ধবের কাছে গিয়ে নিজের বোঝা হালকা খালাশ করে নেবার সৌভাগ্য নেই। ঘুরেফিরে আমার কাছেই আসেন। বিছানার অন্ধকারের মধ্যে বসে থাকেন কোঠায় এসে বারবার উকি দিয়ে যান, দু-চার মিনিটের জন্য আলো জ্বলেন, আলো নিভিয়ে ফেলেন। তারপর আবার চলে অন্ধকারের মধ্যে পায়চারি—এ-কোঠায়, ওকোঠায় সে-কোঠায়—বারান্দায়, এ যেন আর ইহকালেও ফুরবে না, নিজের কোঠায়—চেয়ারে এসে চুপচাপ বসে থাকেন। দক্ষিণের ঘরে পিসিমা, মেজকাকা ও তোমার হাসি-তামাশার কোলাহল ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতে পাই আমরা—কিন্তু এ-ঘরটা খা-খা করতে থাকে। কল্যাণী তার কোঠায়, আমি আমার কোঠায়, বাবা নিজের কোঠায়। জীবনের হাসি-আনন্দকে আমরা কেউই অপছন্দ করি না, কিন্তু পরস্পর এত কাছে থেকেও সে জিনিশ আয়ত্ত করবার অধিকার আমাদের নেই, v>