পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অনেক রাত বসে খবরের কাগজটা চিবিয়ে-চিবিয়ে শেষ করি, তারপর আবার চিবোই, তারপর আবার চিবোই। বাবা থেকে-থেকে উপনিষদের শ্লোক আওড়ান, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন—কল্যাণী তেঁতুলের ঝোল খেয়ে সন্ধ্যারাতেই বাতি নিবিয়ে জীবনের ক্ষমাহীন জীবনস্রোতের কথা ভাবতে থাকে। মা—এই জন্যই তো এই ঘরে আসতে চাই না; এ নিরানন্দের মধ্যে এসে অন্ধকারের ভিতর মুখ গুজে কাদব— —“কিন্তু এটাই তো তোমার ঘর—’ —“সেইজন্যই তো ঘুমোবার সময় এ ঘরে আসি। —আমার ও কল্যাণীর কথা আলাদা। মানুষের জীবনকে তুমিও স্বীকার করেছ, বাবাও স্বীকার করেছেন, তোমাদের বিশ্বাস আছে, ভক্তি আছে, প্রেম আছে, তোমরা প্রার্থনা কর; অথচ তার এক মুহুর্ত আগেও অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক মানুষদের সঙ্গে অবান্তর কথা বল—অথচ তুমি ঘুমোবার সময় এ-ঘরে আসতে চাও শুধু, বাবা না-ঘুমিয়ে ঘুরে মরেন, বুঝি না এ কেমন? —‘একদিন বুঝবে; তুমিই তো একদিন আমাকে চিতায় নিয়ে চড়াবে, সে দিন আমার কপালের সিঁদুরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারবে সব।' —স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে শাড়ি-সিঁদুরের আড়ম্বরের কোনো মূল্য দেই না আমি; হয়তো সিঁদুরের দিকে তাকাবই না; জীবনে কে কাকে কেমন আঘাত করেছে সেই কথাই মনে হবে।’ —যাক, তোমার সঙ্গে মিছিমিছি কথা বলবার কোনো অভিরুচি নেই আমার। মা চুলের ভিতর ধীরে-ধীরে চিরুনি নাড়ছিলেন। —‘পৃথিবীতে যদি অনেকদিন বেঁচে থাকতে হয় তাহলে সৎচরিত্র ধাৰ্মিক আদর্শ গৃহস্থ হয়ে যেন জীবনটা না কাটাই—তার চেয়ে তাড়িখানাও ঢের ভালো।’ —“তোমার যা মনে আসছে, তাই বলছ দেখছি হেম। কিংবা জাহাজের খালাশি হয়ে বেরিয়ে যাব, মিছিমিছি বাবার মতো উঠানে বারান্দায় অন্ধকারে পায়চারি করে শিষ্ট সাধু হয়ে জীবনের সম্ভাবনাটাকে নষ্ট করে কী লাভ? মেজকাকাও করেন না, সেজকাকাও করেন না; প্রতি মুহুর্তেই জীবনের কাছ থেকে নতুন কিছু পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনায় থাকেন। ভিজে শালিকের ঘাড়ের পালকের মতো চুল আঁচড়ানো হয়ে গিয়েছিল মা-র, শাড়ি বদলাতে গেলেন, ফিরে এসে খুকির মাথায় দু-তিন বার হাত বুলিয়ে দক্ষিণের ঘরের দিকে চলে গেলেন। রাত বারোটা-একটার আগে এ ঘরে আর পদধ্বনি শোনা যাবে না। বাবা চমকে উঠে—‘কে?’ ৮২