পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মহিমাময় জায়গায় বিচরণ করতে। মাথা কাত করে ধীরে-ধীরে কপাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে নিচ্ছিল কল্যাণী, চোখ জানলার ভিতর দিয়ে—দূর প্রান্তরের দিকে, কখনো দু-তিনটি নক্ষত্রের পানে। বনলতার কথা মনে হয়—এমনি শান্ত ধূসর শ্রাবণের শেষ রাতে সেও কি কোনো তাকিয়ে আমার কথা ভাবছে এমন করে ? আমি যদি যক্ষ্মায় বিছানা নি, সে যদি খবর পায়, এমনি করে সেও কী শিয়রের পাশে বসে থাকবার জন্য চলে আসবে ? না, তা আসবে না, এমন কোনো নারী নেই যে তার মৃত্যুশয্যা থেকে আমার সান্নিধ্য আকাঙক্ষা করবে। কোনো রূপ নেই, রং নেই, রীতি নেই—কিছুই ঘটে না জীবনে। আকাশ পরিষ্কার ছিল, ভোরবেলা একটু বেড়িয়ে এলাম। বেশ রোদ, আকাশ চমৎকার নীল! শরৎ আসে নি, তবে কাশ এসেছে। বেশি দেরি করলাম না, তাড়াতাড়িই বেড়িয়ে ফিরলাম। খানিকক্ষণ পরে দেখলাম কল্যাণী চা নিয়ে এসেছে। অবাক হয়ে বললাম—“কোথায় চা পেলে ?’ —‘কেন, বাবা তো অনেক দিন হয় তোমার জন্য চা কিনে রেখেছেন।” —‘83 l' —আমার কাছেই রেখেছিলাম—কিন্তু এদিন তোমাকে দেওয়া হয়ে ওঠে নি।’ দেখলাম, বেশ দেখে-শুনে বিচার-সহানুভূতি দিয়ে চা করেছে। চা খাওয়ার পরে একটা বঁটা নিয়ে এল, বললে—“তোমার ঘরটা যে কী হয়ে আছে, ভালো করে বাটও দেয় না কেউ। অনেকক্ষণ বসে বেশ দরদের সঙ্গে বাট দিলে, কোনায় যেখানে যা ময়লা ছিল দেখলাম সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমার বইয়ের তাকটা গুছিয়ে দিল। আমার টেবিলটা গোছাল। মাঝে-মাঝে এসে হাসিমুখে খুকিকে নিয়ে আদর করা, আমাকে মিষ্টি করে কথা বলা—কল্যাণীর এবড় গভীর রূপান্তর। যে-সব জামা-কাপড় ছিড়ে ছিল, বোতাম ছিল না, অনেকক্ষণ বসে সেলাই করে দিল । এক সের আন্দাজ বাংলা সাবান ও নোংরা কাপড়ের গাদি নিয়ে ঘাটে চলে গেল। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর এসে—যাক, আমি যাব না।’ —“কোথায়? মেদিনীপুরে? কেন যাবে না? —বছর তিন-চার নির্মলের দেখা নেই, কেমন যেন লজ্জা করে।’ —‘রোগীর কাছে আবার লজ্জা-সঙ্কোচ কী কল্যাণী ? —“কিন্তু সে তো আমাকে যেতে লেখে নি।’ —‘কে? নির্মল ? মৃত্যুশয্যার থেকে কী করে লিখবে? —“কিন্তু যারা লিখেছেন, তারাও তো আমাকে যেতে লেখেন নি।’ —‘র্তারা মনে করেছেন, ও-রকম রোগের খবর পেলে তুমি নিজে থেকেই যাবে।’ একটু চুপ থেকে—কিন্তু আমার তো টাকাকড়ি নেই, শুধু হাতে গিয়ে কী লাভ। s ○