পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৪২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ট্রায়াল, লুয়াংসির কাছে জাপানিদের অমানুষিক যুদ্ধ—এই সব দূরদূরান্ত, দিগন্তের এবং নিকটের ঘরের নানা রকম চিত্তাকর্ষক সংবাদ ও অসংলগ্ন মন্তব্য লইয়া সমস্ত সকালবেলাটা জমিয়া উঠিত মন্দ না । সমস্ত দুপুর চোগাচাপকন পরিয়া বার লাইব্রেরি ও অশথতলায় কাটাইয়া দেই । বার লাইব্রেরিতে কম—অশথতলায় বেশি। মস্ত বড় অশ্বখগাছটার নীচে শান-বাধানো কয়েকটা বসিবার জায়গা আছে ; কয়েকখানা টিনের চেয়ারও অাছে । বার লাইব্রেরিতে বসিয়া-বসিয়া যখন কিছুতেই শিকার মেলে না আর—উকিলদের কাহাকেও শিয়াল, কাহাকেও শকুন, কাহাকেও দাড়কণক বলিয়া মনে হয়, জীর্ণশীর্ণ উকিলের গাউনে নিজেকে কোনো এক বিগত পৃথিবীর কিভূতকিমাকার জীব বলিয়া বোধ হয়, চারিদিককার আবহাওয়া অসম্ভব ও অপ্রাসঙ্গিক হইয় ওঠে, তখন লাইব্রেরির থেকে হাত-পঞ্চাশেক দূরে আশথ গাছটার দিকে চলিয়া যাই, কোনো দিন বগলে একটা পেনাল কোড থাকে, প্রায়ই কিছু থাকে না সঙ্গে, চাপকান খুলিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করে, চারিদিক হইতে বাতাস ঘনাইয়া উঠিয়া উড়াইয়া লইয়ণ যাইতে চায় আগমণকে, পাশের একটা পুকুরের কিনারে ঝোপজঙ্গলের ভিতর হইতে ডাহুকের শব্দ আসে, সবচেয়ে উঁচু নারিকেল গাছগুলোর মাথায় দু-একটা বাজ পাখি অর্ণ সিয়া পড়ে—সাদা পেট, সাদা গলা, গলার রং খয়ের-গলা জলের মত—বেশ লাগে দেখিতে ; দুপুরের চিকচিকে নারিকেল পাতার ভিতর রোদ মাথায় করিয়া অপরিসীম নীল আকাশের নীচে কণহণকে যে ডাকিতে থাকে তাহারা । চারিদিককার জীবনমৃত্যুর স্রোতের ভিতর, রহস্যবেদনাহত প্রেমিক পরমাত্মাকে ইহারা যেন নতুন করিয়া দুঃখের, বিরহের, করুণ কাতরতার, পুলকের সঙ্গীত শুনাইতে চায়। আমিও শিহরিয়া উঠি । অনেক ক্ষণ বসিয়া থাকি টিনের চেয়ারে—হাতের চুরুট নিভিয়া যায়—বাতাসে শিমূল, কৃষ্ণচূড়া ও নিমসজিনার গুড়ি-ওঁড়ি হলুদ পাতা ঝরিয়া পড়ে, বিন্ধ্য-চিত্রকুটের মত বিরাট এক-এক খণ্ড সাদা মেঘ আকাশের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্তে সরিয়া যায় । কেন যেন দণ্ডকবনের কথা মনে হয়, অশোকবনে সীতার কথা ! কেন যেন নারীকে অশোকের মত রক্তিম ও সুন্দর বলিয়া মনে হয়—কোনো এক নারীকে যেন ; যেন কোন সুদূর সুবর্ণরেখার তীরে, কমলা রঙের মেঘের সন্ধ্যায়, ৪২১