পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তারপর লৌকিক পৃথিবীর ব্যক্তিগত তুচ্ছতার মৃত্ন সংঘর্ষের দেশে সে সব বড়বড় বাতাসের আণক্ষেপ কোথাও কিছু আশ্রয় না পেয়ে নষ্ট হয়ে যেত । জলপাইহাট ছেড়ে কলকাতায় যাবার সময় এই কথাগুলো ভাবছিল নিশীথ । জলপাইহাটতে আর ফিরে আসা হবে না । সুমনা হয় তো মরে যাবে । রানুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ; ভানুও যে ফুরিয়ে যাবে সেটাও নির্দোষ সত্যকথনের অপর পিঠের মতনই সত্য ও নির্মল । অথচ জলপাইহাটিতে এদের সকলকে নিয়ে, হরীতকে নিয়ে একটা যুগ—মানুষের জীবনের এক পুরুষকালই যেন কেটে গেছে নিশীথের । এরা আগজ সকলেই প্রায় বিদায় নিয়েছে – নিচ্ছে ; জলপাইহাটর বাড়িও বিদায় নিয়ে গেল নিশীথের মন থেকে । বিদায়ের ভান করেছিল এর আগে কয়েকবার । কিন্তু সে সব ভগন ভেঙে ফেলবার মত তোড়জোড় ছিল তখন চারিদিককার আবহাওয়ায়, জলপাইহাটিতে, পৃথিবীতে, নিশীথের জীবনের ইতিহাসে। কিন্তু উনিশ শ আটত্রিশ উনচল্লিশ থেকে ইতিহাস যে-মোড় ধরেছে, চল্লিশ-একচল্লিশ-বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশছেচল্লিশে এসে কেমন যেন অস্বাভাবিক দ্রুততায় পুরনো পৃথিবীও স্বভাব শেষ করে দিল সব । রানু যে হারিয়ে গেছে, সুমন যে মরছে, ভানুর যে এই অবস্থা, হারীত যে অলাতচক্রে ঘুরছে, এগুলো কোনো-একটি বিশেষ পরিবারের বিচিত্র ব্যক্তিসর্বস্ব জিনিস নয়—আকস্মিক ঘটনা নয় এ সব—এ-রকম না হয়ে পারত না । নিশীথের নিজের জীবনদৃষ্টিও গত দু-তিন বছরের ভিতর, সময়ের আগুনের ভিতর নিজেকে ক্ষালন করে নিতে-নিতে অনুভব করেছে পৃথিবীর স্থির সত্যগুলো । স্থির হয় তো, কিন্তু কেবলি নতুন ধারাপ্রপাতের দ্রুততার ভিতর দিয়ে, নিজেদের স্থিরভাবে আবিষ্কার করে নিতে ভালবেসে তারা— দ্রুত বিদ্যুতের চূড়োয়-চুড়োয় আকাশও যে বিদ্যুৎ ও পড়—এ-রকম বিভ্রম বিলাস জাগিয়ে তোলে আত্মহারা মানুষের মনে । কিন্তু ঝড়, বিদ্যুৎ, অন্ধকার যখন সমস্ত শেষ করে দিয়ে যাচ্ছে—তখন লক্ষ-লক্ষ মানুষের দিশাভ্রষ্ট হওয় ছাড়া উপায় নেই—হত, নিহত, নির্বাপিত হওয়া ছাড়া পথ নেই—ইতিহাসের দু-তিন পুরুষ, ছ-পুরুষ, এক-পুরুষ যারা এ-রকমভাবে ক্ষরিত হয়ে যায় তারা ভবিষ্যৎ মানুষের মনে জ্ঞান, হৃদয়ে অনুতাপ, শুদ্ধতা বাড়িয়ে দেয় কিনা বলা কঠিন—কিন্তু নিজেদের জ্ঞান সম্পূর্ণ করে যায় এই জেনে যে মানুষের বিদ্যা বাড়লেও তার জ্ঞান বাড়ে না, বাড়াতে গেলেও তা জ্ঞানপাপে দাড়ায় গিয়ে । \(VU)