পাতা:জেলের খাতা - বিপিনচন্দ্র পাল.pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গোটা দুই তিন কঠিন কথা
২৯

প্রতীকোপাসনা ও সাকারবাদ

 প্রতীকোপাসনাই অতি স্থূলভাবে সাকারোপাসনা বলিয়া বিবেচিত হয়। কাষ্ঠলোষ্ট্রের উপাসনা প্রতীকোপাসনার অন্তর্গত। দেশ-প্রচলিত প্রতিমা-পূজাকে ঠিক প্রতীকোপাসনা বলা যায় কি না, সন্দেহের কথা। কারণ, মুর্ত্তিমাত্রেই যদিও প্রতীক তথাপি ভগবদস্বরূপের কোনো না কোনো ধর্ম্মের সঙ্গে প্রতিমাদির স্বল্পবিস্তর সামান্যধর্ম্ম প্রকাশেরও চেষ্টা হইয়া থাকে। প্রতিমাপূজাতে এইজন্য সম্পদ ও প্রতীকের মাঝামাঝি একটা ভাব আছে। ইহাকে প্রতীকাশ্রিত সম্পদুপাসনা বলা যাইতে পারে। যাহা হোক, প্রতীকোপাসনকে বেদান্তে আধ্যাসজনিত উপাসনা বলে। অধ্যাস অর্থ-পরত্রদৃষ্ট অন্যত্রাবভাসঃ—অন্যত্রদৃষ্ট কোন বস্তুকে যেস্থানে তাহা প্রকৃতপক্ষে নাই, সেখানে আরোপ করার নাম অধ্যাস। কোনোকালে বনে যে সর্প দৃষ্ট হইয়াছিল, গৃহস্থিত রজ্জুতে সেই সর্পের অস্তিত্ব আরোপ করাকে অধ্যাস বলে। ইহা অধ্যাসের ধর্ম্ম। প্রতীকোপাসনা অধ্যাসজনিত উপাসনা; ইহার অর্থ এই যে, শাস্ত্রে শ্রুত উপদেশ প্রাপ্ত, অথবা আপনার বুদ্ধিতে প্রকাশিত, বা আত্মাতে আভাস রূপে অনুভূত যে ঈশ্বরতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব, তাহাকে, যে বস্তুতে তাহার স্বতঃ প্রকাশ নাই, তাহাতে আরোপ করিয়া, ঈশ্বর বা ব্রঙ্গরূপে সে। বস্তুর পূজা করাই প্রতীকোপাসনা। এখানেও সুতরাং সাধক একে বারে নিরাকাণ্ড ঈশ্বরতত্ত্বের জ্ঞানবর্জ্জিত নহেন। উপাসনার অবলম্বন সাকার অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হইলেও, উপাস্য যিনি, তিনি নিরাকার অতীন্দ্রিয়; প্রতীকোপাসনায়ও জ্ঞানের অভাব বা বিলোপ হয় না। সুতরাং প্রতীকোপাসনাকেও প্রকৃতপক্ষে সাকারবাদ বলা যায় না; তবে ইহা নিরুষ্ট আধিকাব, বেদান্ত স্বয়ংই এ কথা স্বীকার করেন।