পাতা:জেলের খাতা - বিপিনচন্দ্র পাল.pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রাণের কথা
৩৯

ভার এ জগতে স্বল্পবিস্তর পরিমাণে, আপন আপন প্রকৃতি প্রত্যেক জীবকেই বহন করিতে হইতেছে। আর পুর্ব্বপুরুষের দোষগুণের ভার যে সকল মানুষকেই বহিতে হয়, এ তো প্রত্যক্ষ কথা। পিতার কর্ম্মবোঝা মাথায় লইয়া পুত্র জন্মগ্রহণ করে। একরতি শিশুও তার সামান্য ইচ্ছার ব্যাঘাত জন্মিলে, যে ক্রোধাবেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া, বিকারগ্রস্ত রোগীর ন্যায়, দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া আপনার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিক্ষেপে প্রাণহানির আশঙ্কা পর্যন্ত জাগাইয়া তোলে,—এ কি কেবল তার নিজের কর্ম্মের ফলে, না,—পিতার ক্রোধ, মাতার অপস্মার, পিতামহের পারষ্য, মাতামহের মাৎসর্য্য, এইরূপ পুরুষপরম্পরাগত সঞ্চিত কর্ম্মের পরিণাম? জীব একাকী জন্মগ্রহণ করে, একথা সত্য, কিন্তু সে কেবল আপনার কর্ম্মবোঝা মাথায় লইয়া কর্ম্মটুকু মাত্র ক্ষয় করিতে এ সংসারে আসে, ইহা সত্য নহে। এই বাংলা দেশে জন্মিয়া, এই মাটীর দোষগুণের বোঝা কি সকল বাঙ্গালীকে বহিতে হইতেছে না? মাটীর গুণে, জলের গুণে, হাওয়ার গুণে, বঙ্গবাসী বাঙ্গালী হইয়াছে, শিখ শিখ হইয়াছে, রাজপুত রাজপুত হইয়াছে, গুজ্‌রাটী গুজ্‌রাটী হইয়াছে, মারাঠা মারাঠা হইয়াছে,—তামিল, তৈলঙ্গী সকলেই আপনার দেহে আপন আপন মাটীর দোষগুণের বোঝা বহিতেছে; কেহ বা দীর্ঘাকৃতি কেহ বা খর্ব্বকায়, কেহ বা বলিষ্ঠ কেহ বা দুর্ব্বল, কেহ বা কর্ম্মঠ কেহ বা অকর্মণ্য হইয়াছে,—ইহা কি সত্য নহে? মানুষ কেবল নিজের সুকৃত দুষ্কৃত বোঝা লাইয়াই এ সংসারে জন্মগ্রহণ করে, এই যদি সত্য হয়, তবে সংসারের সকল সম্বন্ধই শিথিল ও গ্রন্থিহীন হইয়া পড়ে। একের সঙ্গে অপরের সুখদুঃখের ও পাপপুণ্যের এই যে বিপুল, এই যে জটিল বন্ধন, তাহা নিতান্তই কাল্পনিক, মায়িক, অলীক হইয়া দাঁড়ায়। তবে এ জগতে কে আর কার অপেক্ষা রাখে? কে কার জন্য দায়ী হয়? পিতা পুত্রের জন্য, পুত্র পিতার জন্য, পতি পত্নীর জন্য, পত্নী পতির