পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৩৮

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জোড়াসাঁকোর ধারে
৩১

বাবামশায়ের তামাক খাবার সময় হয়ে এসেছে। ঠিক সময়ে তামাক দিতে না পারলে মহামুশকিল। মণিখুড়োকে জিজ্ঞেস করে; তিনি বলেন, ‘কই বাবা, দেখিনি কিছু। আমি তো এখানে বসে সেই থেকে হুঁকো খাচ্ছি। তবে কি জান, যে আগুন খেয়েছে তাকে কয়লা ওগরাতেই হবে। ভেবে কি করবে। এই দেখনা কাল আমার জুতোজোড়াটি কেমন লোপাট হয়ে গেল। খুঁজে দেখ, পাবে হয়তো—যাবে কোথায়? বিশ্বেশ্বর বললে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা হলে খুজে দেখি। আপনার জুতোই বা যাবে কোথায়?’ বলে ঘরের এ-কোণায় ও কোণায় খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গা থেকে কাগজে-মোড়া জুতো বের করে আনলে; বললে, ‘বাবু, এই যে আপনার জুতো পাওয়া গেছে।’ মণিখুড়ো বললেন, ‘ওই যে ওই কোণায় তোমার মুখনল চকচক করছে।’ বিশ্বেশ্বর তাড়াতাড়ি জুতো ফেরত দিয়ে মুখনল নিয়ে বাঁচে।

 দেউড়িতে দরোয়ানদের বৈঠক। মনোহর সিং বুড়ো দরোয়ান—মস্ত লম্বা চওড়া, ফরসা গায়ের রঙ, ধবধব করছে সাদা দাড়ি। সকালে সে একদিকে খালি গায়ে লুঙ্গি প’রে বসে দই দিয়ে দাড়ি মাজে আর চারদিকে অন্য দরোয়ানরা কুস্তি করে, ডাম্বেল ভাঁজে। একপাশে এক দরোয়ান একটা মস্ত গয়েশ্বরী থালাতে একতাল আটার মাঝখানে গর্ত করে তাতে খানিকটা ঘি ঢেলে মাখতে থাকে। সে এক পর্ব সকালবেলায় দেউড়িতে। এদিকে মনোহর সিং দই দিয়ে দাড়িই মাজছে বসে বসে। ঘণ্টাখানেক এইভাবে মেজে বাঁ হাতে ছোট্ট একটি টিনের আয়না মুখের সামনে ধ’রে, একরকম কাঠের চিরুনি থাকত তার ঝুঁটিতে গোঁজা, সেই চিরুনি দিয়ে দাড়ি বেশ করে আঁচড়ে কাপড়জামা পরে কোমরে ফেটি বেঁধে, একপাশে প্রকাণ্ড কাঠের সিন্দুক, তাতে ঠেস দিয়ে দোজানু হয়ে যখন বসে দু উরুতে দু হাত রেখে, কি বলব, ঠিক যেন পাঞ্জাবকেশরী বসে আছে ঢাল-তলোয়ার পাশে নিয়ে। শুভ্রবেশ তার, গলায় মোটা মোটা আমড়ার আঁঠির মতো সোনার কণ্ঠি, হাতে বালা, কোমরে গোঁজা বাঁকা ভোজালি, সে ছিল দেউড়ির শোভা। পশমের মতো সাদা লম্বা দাড়ি কি সুন্দর লাগত। ছেলেবুদ্ধি— দেখেই একদিন কি ইচ্ছে হল, হাত দিয়ে ধরে দেখব তা। যেই না মনে হওয়া খপ করে গিয়ে তার দাড়ি চেপে ধরলুম মুঠোর মধ্যে। মনোহর সিং অমনি গর্জন করে কোমরের ভোজালিতে হাত দিলে। আমি তো দে ছুট একেবারে দোতলায়। ভয়ে আর নামিনে একতলায়। প্রাণের ভিতর ধুক্‌ ধুক্‌ করছে, কি জানি কি অন্যায় বুঝি করে ফেলেছি। এবার আমায় দরোয়ানজি