পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৪০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জোড়াসাঁকোর ধারে
৩৩

বাবামশায়েরও ছিল একটি সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া লালসুতোয় বাঁধা—আগে থেকেই ঢোলে কি সব মাখিয়ে ঢোল তৈরি করে বাবামশায়ের ঢোল যেত বৈঠকখানায়, দরোয়ানদের ঢোল থাকত দেউড়িতেই। হোরির দিন ভোরবেলা থেকে সেই ঢোল গুরুগম্ভীর স্বরে বেজে উঠত; গানও কি সব গাইত, কিন্তু থেকে থেকে ওই ‘হোরি হ্যায় হোরি হ্যায়’ শব্দ উঠত। বেহারাদেরও সেদিন ঢোল বাজত; গান হত ‘খচমচ খচমচ’, যেন চড়াইপাখি কিচির কিচির করছে। আর দরোয়ানদের ছিল মেঘগর্জন; বোঝা যেত যে, হ্যাঁ, রাজপুত-পাহাড়ীদের আভিজাত্য আছে তাতে। নাচও হত দেউড়িতে। কোত্থেকে রাজপুতানী নিয়ে আসত, সে নাচত। বেশ ভদ্ররকমের নাচ। আমরাও দেখতুম। বেহারাদের নাচ হত, পুরুষরাই মেয়ে সেজে নাচত সে কী রকম অদ্ভূত বীভৎস ভঙ্গীর, দু হাত তুলে দু বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধেই ধেই নাচ আর ওই এক খচমচ খচমচ শব্দ। উড়েরাও নাচত সেদিন দক্ষিণের বাগানে লাঠি খেলতে খেলতে। বেশ লাগত। উড়েদের নাচ আরম্ভ হলেই আমরাও ছুটতুম ‘চিতাবাড়ি’ দেখতে।

 দোতলায় বাবামশায়ের বৈঠকখানায়ও হোলির উৎসব হত। সেখানে যাবার হুকুম ছিল না। উঁকিঝুঁকি মারতুম এদিক ওদিক থেকে। আধ হাত উঁচু আবিরের ফরাস। তার উপরে পাতলা কাপড় বিছানো। তলা থেকে লাল আভা ফুটে বের হচ্ছে। বন্ধুবান্ধব এসেছেন অনেক— অক্ষয়বাবু তানপুরা হাতে বসে, শ্যামসুন্দরও আছেন। ঘরে ফুলের ছড়াছড়ি। বাবামশায়ের সামনে গোলাপজলের পিচকারি, কাচের গড়গড়া, তাতে গোলাপজলে গোলাপের পাপড়ি মেশানো, নলে টান দিলেই জলে পাপড়িগুলো ওঠানামা করে। সেবার এক নাচিয়ে এল। ঘরের মাঝখানে নন্দফরাশ এনে রাখলে মস্ত বড় একটি আলোর ডুমটি। নাচিয়ে ডুমটি ঘুরে ঘুরে নেচে গেল। নাচ শেষ হল; পায়ের তলায় একটি আলপনার পদ্ম আঁকা। নাচের তালে তালে পায়ের আঙুল দিয়ে চাদরের নিচের আবির সরিয়ে সরিয়ে পায়ে পায়ে আলপনা কেটে দিলে। অদ্ভুত সে নাচ।

 বৈঠকখানা আর দেউড়ির উৎসব, এ দুটোর মধ্যে আমার লাগত ভালো রাজপুত দরোয়ানদের উৎসবটাই। বৈঠকখানায় শখের দোল শৌখিনতার চুড়ন্ত—সেখানে লট্‌কনে ছোপানো গোলাপী চাদর, আতর, গোলাপ, নাচ, গান, আলো, ফুলের ছড়াছড়ি। কিন্তু সত্যি দোল-উৎসব করত দরোয়ানরাই—উদ্দণ্ড উৎসব, সব লাল, চেনবার জো নেই। সিদ্ধি খেয়ে চোখ দুটো পর্যন্ত সবার লাল।