পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৪৪

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জোড়াসাঁকোর ধারে
৩৭

বলেছি। এবারে বলি তবে ছিরুমেথরের চরিত্র। তাদের ঘর খোলা দিয়ে ছাওয়া; বাদামতলায় কাত হয়ে পড়েছে ঝড়ে জলে। সারাদিনমান তেঁতুলগাছের ছায়াতেই ঢাকা সেই কোণটা; রোদ পড়তে দেখিনে। হ্যাংলা কুকুরছানাগুলোর ডাক এসে পৌঁছয় সেদিক থেকে কানে। কুকুরের তাড়া খেয়ে হাঁস মুরগি থেকে থেকে ক্যাঁ-ক্যাঁ চীৎকার ছাড়ে। সেই ছায়ায় অন্ধকারে ছিরুমেথরের ঘরের দাওয়া দেখা যায়। একধারে একটা জলের জালা, আধখানা তার মাটিতে পোঁতা। সেই ঠাণ্ডা জালার জলে কাজের শেষে ছিরুমেথর চান করে দেখি। কালো তার রঙ। ভারি শৌখিন ছিল ছিরুমেথর। কালো হলেও ছিরুর চেহারা ছিল বেশ; কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মুখের কাটকোটও সুন্দর। বিলিতি মদ খাওয়া তার অভ্যেস ছিল। দেশি মদ ছুঁ'ত না। বিলিতি মদ খেলেই তার মুখে ফর্‌ ফর্‌ করে ইংরেজি গরম গরম গালাগালি বের হয়— ড্যাম ইউ রাস্কেল। ইংরেজি বুলি শুনলেই বোঝা যেত লোকটা ‘খেয়েছে’। বাড়ি রাস্তাঘাট পরিপাটি রাখা কাজ ছিল তার। সামনের রাস্তা ঝাঁট দিয়ে চলে গেল যেন ধুলোর উপরে আলপনা এঁকে দিলে ঝাঁটা দিয়ে, জলে ঢেউ খেলিয়ে দিলে। রাস্ত ঝাঁটানোর আর্টিস্ট তাকে বলা যেতে পারে। একদিন হল কি, বাড়িরই কে যেন ডেকেছে ছিরুকে। দরোয়ান গেছে ডাকতে। সে ছিল মউজে; যে মেথরটা হুকুম শুনবে সে তখন তো নেই, ইংরেজি-বুলি-বলা আর একটা মানুষ তার মধ্যে বসে আছে। দরোয়ান যেই না কাছে গিয়ে তাকে ডাক দিয়েছে অমনি ছিরু শুরু করেছে ইংরেজিতে গালাগালি। কিছুতেই আর তাকে থামানো যায় না। তখন দরোয়ানও হিন্দি বুলিতে তেরিমেরি করে যেমন লাঠি তোলা—বাস্‌, সাহেবের অন্তর্ধান। ছিরুমেথরের মধ্যেকার ভেতো বাঙালিটা হঠাৎ ফিরে এসে দরোয়ানজির পায়ে ধরতে চায়, ‘মাপ করে, দরোয়ানজি, ঘাট হয়েছে।’ ‘আরে ছুঁয়ো মৎ, ছুঁয়ো মৎ’ বলে দরোয়ান যত পিছয় ছিরু তত এগিয়ে আসে। শেষে দরোয়ানের ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন জাত যাবার ভয়ে। ছিরুর বুদ্ধি দেখে আমরা অবাক। দরোয়ান মেথরে এ প্রহসন প্রায়ই দেখতুম আর হাসতুম। ছিরুর আর এক কীর্তির কথা ছোটপিসেমশায় বলতেন, ‘জানিস? মল্লিকবাড়িতে বিয়ের মজলিসে গেছি। দেখি, শিমলের ধুতিচাদর জুতোমোজা পরে ফিট্‌বাবু সেজে ছিরুটা মজলিসের একদিকে বসে সটকা টানছে, আমাকে দেখেই দে চম্পট।’

 বাবুয়ানি কায়দার দোরস্ত ছিল ছোট বড় খানসামা চাকর পর্যন্ত সবাই