পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৬৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৫৮
জোড়াসাঁকোর ধারে

বাবরি চুল, গোঁফে তা, কড়ে আঙুলে একটা আংটি। গানও গাইতেন মাঝে মাঝে, খুব দরাজ গলা ছিল। গান কিছু বড় মনে নেই, সুরটাই আছে কানে এখনও বড় বড় রাগরাগিণীর—আমি তখন কতটুকুই বা, ছয়-সাত বছর বয়স হবে আমার। এখন, অক্ষয়বাবু তো বসে আছেন চৌকিতে সেই নতুন ফ্যাশানের পেলেট দেওয়া শার্ট গায়ে দিয়ে। আমি কাছে গিয়ে অক্ষয়বাবুর বুকের মড়মড়ে পেলেটে হাত বোলাতে বোলাতে বললুম, “অক্ষয়বাবু এ যে শার্সি খড়খড়ি লাগিয়ে এসেছেন।’ যেমন বলা বারান্দাসুদ্ধ সকলের হো-হো হাসি, ‘শার্সি খড়খড়ি’। হাসি শুনে ভাবলুম কি জানি একটা অপরাধ করে ফেলেছি। চোঁচাঁ দৌড় সেখান থেকে। বিকেলে আবার শুনি, সেই আমার ‘শার্সি খড়খড়ি’ পরার কথা নিয়ে হাসি হচ্ছে সবাইকার।

 দরজি চীনাম্যান, তারাও এক-একটা টাইপ, তাই চোখের সামনে স্পষ্ট তাদের দেখতে পাই এখনো। ঈশ্বরবাবু শিখিয়ে দিয়েছিলেন চীনে ভাষা, ইরেন দে পাগলা, উড়েন দে পাগলা, কা সে।’ ভাবটা বোধ হয়, জুতো এ পায়েও গলাই ও পায়েও গলাই, দুপায়েই লাগে কষা। চীনাম্যান এলেই আমরা চীনেম্যানকে ঘিরে ঘিরে ওই চীনে ভাষা বলতুম, আর সে হাসত। ঢিলেঢালা পাজামা, কালো চায়নাকোট গায়ে, ঠিক তার মতই টাক-টিকিতে সেজে এক চীনেম্যানরূপে বেরিয়েছিলুম ‘এমন কার্য আর করব না’ প্রহসনে।

 শ্রীকণ্ঠবাবু আসতেন। এই এখানকার রায়পুর থেকে যেতেন মাঝে মাঝে কলকাতায় কর্তামশায়ের কাছে। বুড়োর চেহারা মনে আছে, পাকা আমটির মত গায়ের রঙ, জরির টুপি মাথায়। গাইতেন চৌকিতে বসে ‘ব্রহ্মকৃপাহি কেবলম্’ আর ‘পুণ্যপুঞ্জেন যদি প্রেমধনং কোঽপি লভেৎ’। আমরাও দুহাত তুলে গাইতুম, ‘কোঽপি লভেৎ কোঽপি লভেৎ’। সেদিন শুনলুম ৭ই পৌষে ছাতিম তলায় এই গান। শুনেই মনে হল শ্রীকণ্ঠবাবুর মুখে ছেলেবেলায় শেখা গান। ষাট-সত্তর বছর পরে এই গান শুনে মনে পড়ে গেল সেই দক্ষিণের বারান্দায় শ্রীকণ্ঠবাবু গাইছেন, আমরা নাচছি। ছোট্ট একটি সেতার থাকত সঙ্গে, সেইটি বাজিয়ে আমাদের নাচাতেন। বড় ভালোবাসতেন তিনি ছোট ছেলেদের। কর্তা মশায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব ছিল। তারই বাড়িতে আসতে মাঝপথে তিনি বিশ্রাম নিতেন ওই ছাতিমতলায়। স্টেশন থেকে পালকি করে এসে এইখানে নেমে বিশ্রাম নিয়ে তবে যেতেন রায়পুর সিংহিদের বাড়ি। বড় ভালো লেগেছিল