পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৬
জোড়াসাঁকোর ধারে

একটা বয়স আসে যখন এইসব ভুলে থাকবার জিনিসের দরকার হয়। একবার ভেবেছিলুম লেখাটা আবার ধরব, কিন্তু তাতে মাথার দরকার। এখন আর মাথার কাজ করতে ইচ্ছে যায় না। গল্প বলি, এটা হল মনের কাজ। এই মনের কাজ আর হাতের কাজই এখন আমার ভালো লাগে। তাই পুতুল গড়তেও আমার কষ্ট হয় না। সেখানে হাত চোখ আর মন কাজ করে। অন্য আর কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করে না। রবিকা যে বৈকুণ্ঠের খাতায় তিনকড়ির মুখ দিয়ে আমাকে বলিয়েছিলেন ‘জন্মে অবধি আমার জন্যেও কেউ ভাবেনি আমিও কারো জন্য ভাবতে শিখিনি’, এই হচ্ছে আমার সত্যিকারের রূপ। রবিকা আমাকে ঠিক ধরেছিলেন। তাই তো তিনকড়ির পার্ট অমন আশ্চর্য রকম মিলে গিয়েছিল আমার চরিত্রের সঙ্গে। ও সব জিনিস অ্যাকটিং করে হয় না। করুক তো আর কেউ তিনকড়ির পার্ট, আমার মত আর হবে না। ওই তিনকড়িই হচ্ছে আমার আসল রূপ। আমি নিজের মনে নিজে থাকতেই ভালোবাসি। কারো জন্য ভাবতে চাইনে, আমার জন্যও কেউ ভাবে তা পছন্দ করিনে। চিরকালের খ্যাপা আমি। সেই খ্যাপামি আমার গেল না কোনোকালেই। আমার নামই ছিল বোম্বেটে। দুরন্তও ছিলুম, আর যখন যেটা জেদ ধরতুম সেটা করা চাই-ই। তাই সবাই আমার ওই নাম দিয়েছিলেন। রবিকারাও চিরকাল ওই ‘খ্যাপা’ ‘পাগলা” বলে আমাকে ডাকতেন। আমিও যেন তাদের কাছে গেলে ছোট্ট ছেলেটি হয়ে যেতুম। এই সেদিনও রবিকাদের কাছে গেলেই আমার বয়স ভুলে আমি যেন সেই পাগলা খ্যাপা হয়ে যেতুম। তাঁরাও আমায় সেইভাবেই দেখতেন। কিছুকাল আগে যখন সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এসেছিলেম, রবিকার হুকুমে প্রতিমা ও কারপ্লেজ, ওরা মিলে আমার থাকবার জন্য ঘর সাজিয়েছে যেন একটা বাসরঘর। আমি আবার আস্তে আস্তে সব তুলে রাখি, কি জানি কোন্‌টা ময়লা হয়ে যাবে। নিজের বিছানাপত্র খুলে নিই। সকালে উঠেই আমাকে এই বকুনি, ‘না, ও সব তুমি কি করছ।’ বলে আবার সেইভাবে ঘরদোর সাজিয়ে দেওয়ালেন।

 জ্যোতিকাকার কাছে রাঁচিতে গেলুম, তখন তো আমি কত বড়, ছেলেপুলে নাতিনাতনি আমার চারদিকে। জ্যোতিকাকামশায় রোজ সকালে টুং টুং করে রিক্‌শ বাজাতে বাজাতে বেড়িয়ে ফিরতেন। কোলের উপর একটি কেকের বাক্স। রিক্‌শ থেকে নেমে কেকের বাক্সটি আমার হাতে দিয়ে বলতেন, ‘অবন, তোমার জন্য এনেছি, তুমি খেয়ো।’ ঘর ভরতি নাতিনাতনি, সে সব ফেলে আমার জন্য