পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮২
জোড়াসাঁকোর ধারে

দেখেছি তাকে দু-একবার লামার সঙ্গে। সে এসেই তো খুব দুঃখ করলে তার স্বামীর জন্যে। বেচারা দেখতেও পায়নি শেষ সময়ে। তারও শরীর অসুস্থ ছিল। এতদিন তাই আসতে পারেনি। স্বামী নানা দেশবিদেশে জিনিসপত্তর বিক্রি করত, নানা জায়গায় টাকা পড়ে আছে তার। ‘বললুম, কদিন আগে তার ভাই এসেছিল যে টাকার জন্য। আমি দিইনি।’ সে বললে, ‘তা দাওনি, বেশ করেছ। আমি এসেছি তোমাদের কার কাছে তার কি জিনিসপত্তর আছে সেই খোঁজে। তোমার কাছে তো সে খুব আসত, তুমি জানো, কোথায় কি দিয়ে গেছে শেষবার।’ আমি বললুম, ‘শেষবারে সে কতকগুলি কাঞ্জুরের পুঁথি এনেছিল। আমি তাকে হরিনাথ দের কাছে পাঠিয়েছিলুম। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলুম, তিনি সেই পুঁথিগুলি খুব দাম দেবেন বলেই রেখেছিলেন। সেও ফিরে এসে নেবে বলে চলে যায়। তুমি সেখানে গিয়ে খোঁজ করো, পাবে। সে বললে, ‘আমি গিয়েছিলেম সেখানে, কিন্তু তারা কেউ সে পুঁথির সন্ধান দিতে পারেনি। হরিনাথ দে মারা গেছেন। পুঁথি যে কি হল কেউ জানে না।’ বহু পরে আমি সেই পুঁথি দেখি সাহিত্য-পরিষদে। দেখেই চিনেছি—আমার হাত দিয়ে গেছে পুঁথি, আর আমি চিনব না! যাক সে কথা, মেয়েটি তো তার দাম বা সন্ধান কিছুই পেলে না। আমি বললুম, ‘আমাকে দিয়ে গিয়েছিল সেবারে সে এই আংটির পলাটি, এটির দাম আমি তাকে দিয়েছি। আর দিয়েছিল একটি নাসদানি, দাম নেয়নি, ফিরতি পথে নেবে বলেছিল; কিন্তু সে তো আর এল না এ পথে, তুমি সেটা নিয়ে যাও।’ শুনে বুড়িটি অনেকক্ষণ চোখ বুজে চুপ করে রইল। পরে বললে, ‘আমি তো সব জানি। সেই নাসদানিটি একবার দেখতে চাই। দেখাবে?’ বললুম, ‘তা তো এখানে নেই, বিকেলে আমার বাড়িতে এসো তাহলে।’ বাড়ি সে চিনত।

 বিকেলে এল, আমিও ফিরেছি কাজ সেরে। অলকের মা সিন্দুকে তুলে রেখেছিলেন কৌটোটি, তাঁকে বললুম, ‘বের করে দাও ওটি, এতদিন পরে তার মালিক এসেছে।’ কৌটোটি এনে দিলুম বুড়ির হাতে। বললুম, ‘সে পঞ্চাশ টাকা চেয়েছিল, তখন অত দাম দিতে চাইনি। তা তুমি এখন অভাবে পড়েছ যা চাইবে দেব। নয় তোমার জিনিস তুমি ফিরিয়ে নাও। তাতেও আমি অসন্তুষ্ট নই।’ বুড়ি বললে, ‘হ্যা, এ-জিনিসটি দেখেছি তার কাছে।’ বলে দু হাতে তা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যত দেখছে আর দু চোখের ধারা বয়ে যাচ্ছে।