সন্ন্যাস তাহার ধর্ম্ম ছিল না। ভগবান যেরূপ সত্য তাঁহার লীলাও তদ্রূপ সত্য; ব্রহ্ম সত্য বলিয়া জগৎ মিথ্যা নয়। অতএব ভগবানকে পাইতে হইলে রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ—এ সব বর্জ্জন করিরার কোনও প্রয়োজন নাই। ভগবানের লীলা অনন্ত; সেই লীলার রঙ্গমঞ্চ শুধু বহির্জগতে নয়, মানুষের অন্তরেও। মনুষ্য-হৃদয় নিত্যবৃন্দাবন, সেই বৃন্দাবনে জীবের সহিত ভগবানের, রাধার সহিত কৃষ্ণের অনন্ত লীলা চলিয়াছে। তিনি রসময়; তাই সকল রসের মধ্য দিয়া তাঁহাকে পাইতে হইবে। এরূপ মত যিনি পোষণ করেন তিনি যে নেতি-মার্গ হইতে পারেন না—এ-কথা বলা বাহুল্য। বস্তুতঃ দেশবন্ধু বিশ্ব-সংসারকে, তথা মনুষ্য জীবনকে, পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারিয়াছিলেন; দ্বৈতাদ্বৈতবাদের সাহায্যে সে জীবনের সকল প্রকার বিরোধ দূর হইয়া যায় এবং সর্ব্বত্র সামঞ্জস্য সংস্থাপিত হয়—এ কথা তিনি বিশ্বাস করিতেন। তাই বৈষ্ণব-ধর্ম্ম হইয়াছিল তাঁহার জীবনের শেষ আশ্রয়। তিনি কথাবার্ত্তায় এবং বক্তৃতায় প্রায়ই বলিতেন যে, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম্ম—এ সব আলাদা করিয়া দেখিলে চলিবে না, পরস্পরের মধ্যে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ আছে এবং একটিকেও বাদ দিলে জীবন পূর্ণ হইবে না।
যে দার্শনিকতত্ত্ব তাঁহার ধর্ম্মরাজ্যের সকল বিরোধ ভঞ্জন করিয়াছিল তাহার বাস্তবরূপ প্রেমের মধ্য দিয়া তাঁহার ব্যবহারিক জীবনে সকলের মধ্যে প্রীতি ও মৈত্রী সংস্থাপন করিয়াছিল। তিনি তাঁহার জীবনে লামজাত (synthesis) লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া কর্ম্মক্ষেত্রে ভিন্নরুচি ও ভিন্ন মতাবলী লোকদের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে পারিতেন। তাঁহার নিজের মধ্যে কোনও প্রকার গোঁজামিল ছিল না বলিয়া তিনি অপরের মধ্যে বিরোধ বা গোঁজামিল সহ করিতে পারিতেন না।