পাতা:তিনসঙ্গী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫১

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
শেষ কথা
৪৯

কিন্তু মরে নি। পাস করেছে। করেই ইণ্ডিয়া গবর্মেণ্টের উচ্চপদস্থ একজন মুরুব্বির মেয়েকে বিয়ে করেছে। লজ্জায় ক্ষোভে নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে মর্মাহত মেয়েটিকে নিয়ে অধ্যাপক কোথায় যে অন্তর্ধান করেছেন, তার খবর রেখে যান নি।’

 চিঠিখানা পড়লুম। দৃঢ় সংকল্প করলুম, এই মেয়েটিকে তার লজ্জা থেকে অবসাদ থেকে উদ্ধার করব।

 ইতিমধ্যে অচিরার সঙ্গে কোনোরকম করে একটা কথা আরম্ভ করবার জন্যে মন ছটফট করতে লাগল। যদি বিজ্ঞানী না হয়ে হতুম সাহিত্যরসিক, কিংবা বাঙাল না হয়ে যদি হতুম পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক, তা হলে নিশ্চয় মুখে কথা বাধত না। কিন্তু বাঙালি মেয়েকে ভয় করি, চিনি নে বলে বোধ হয়। একটা ধারণা ছিল, হিন্দুনারী অজানা পরপুরুষমাত্রের কাছে একান্তই অনধিগম্য। খামকা কথা কইতে যাই যদি, তা হলে ওর রক্তে লাগবে অশুচিতা। সংস্কার জিনিসটা এমনি অন্ধ। এখানে কাজে যোগ দেবার পূর্বে কিছুদিন তো কলকাতায় কাটিয়ে এসেছি—আত্মীয়-বন্ধুমহলে দেখে এলুম সিনেমামঞ্চ-পথবর্তিনী রঙমাখানো বাঙালি মেয়ে, যারা জাতবান্ধবী, তাদের— থাক্‌ তাদের কথা। কিন্তু অচিরার কোনো পরিচয় না পেয়েই মনে হল, ও আর-এক জাতের— একালের বাইরে আছে দাঁড়িয়ে, নির্মল আত্মমর্যাদায়, স্পর্শভীরু মেয়ে। মনে মনে কেবলই ভাবছি, প্রথম একটি কথা শুরু করব কী করে।

 এই সময়ে কাছাকাছি দুই-একটা ডাকাতি হয়ে গিয়েছিল। মনে হল এই উপলক্ষে অচিরাকে বলি, ‘রাজাকে বলে আপনার জন্যে পাহারার বন্দোবস্ত করে দিই!’ ইংরেজ মেয়ে হলে হয়তো এই গায়ে-পড়া আনুকূল্যকে স্পর্ধা মনে করত, মাথা বাঁকিয়ে বলত, ‘সে ভাবনা আমার’; কিন্তু এই বাঙালির মেয়ে যে কী ভাবে কথাটা নেবে, আমার সে অভিজ্ঞতা নেই। দীর্ঘকাল বাংলার বাইরে থেকে আমার মনের অভ্যাস অনেকখানি জড়িয়ে গেছে বিলিতি সংস্কারে।

8