পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

না। টুপি মাথায় দিয়া আমি দ্বারের নিকট গিয়া দাঁড়াইব। সকলে উঁকি মারিয়া দেখিবে, আর ফিরিয়া যাইবে,— আর বলিবে,— 'ও গাড়ীতে সাহেব রহিয়াছে।' কেমন কঙ্কাবতী? এ পরামর্শ ভাল নয়?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “উত্তম পরামর্শ! এক্ষণে অনুগ্রহ করিয়া পথ বলিয়া দিন! আর যদি না দেন, তো বলুন আমি চলিয়া যাই!”

 কানে হাত দিয়া ব্যাঙ জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি বলিলে?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কোন পথ দিয়া গ্রামে যাইব? গ্রাম এখান হইতে কতদূর কতক্ষণে সেখানে গিয়া পৌঁছিব?”

 ব্যাঙ বলিলেন,— “আমার একটা হিসাব করিয়া দাও। পথ দেখাইয়া দিব কি, আমি এখন ঘোর বিপদে পড়িয়াছি। আমার একটি আধুলি ছিল; একজনকে তাহা আমি ধার দিয়াছি। তাহার সহিত নিয়ত হইয়াছে যে, যাহা বাকী থাকিবে, প্রতিদিন তাহার অৰ্দ্ধেক দিয়া সে ঋণ পরিশোধ করিবে। প্রথম দিন সে আমাকে চারি আনা দিবে, দ্বিতীয় দিন দুই আনা দিবে, তৃতীয় দিন এক আনা, চতুর্থ দিন দুই পয়সা, পঞ্চম দিন সে একপয়সা দিবে। একপয়সায় হয় পাঁচ গণ্ডা, অর্থাৎ কুড়ি কড়া। ষষ্ঠ দিনে সে আমাকে দশ কড়া দিবে। তার পরদিন সে আমাকে পাঁচ কড়া দিবে। তার পরদিন আড়াই কড়া, তার পরদিন স-কড়া, তার পরদিন তার অর্দ্ধেক, পরদিন তার অর্দ্ধেক, পরদিন তার অর্দ্ধেক—"

 অতি চমৎকার সুমিষ্ট কান্না-সুরে ব্যাঙ এইবার গলা ছাড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন,— “ওগো! মা গো! এ যে আর কখনও শোধ হবে না গো, আমার আধুলিটি যে, আর কখনও পূরাপূরি হবে না গো! ওগো আমি কোথায় যাব গো! জুয়াচোরের হাতে পড়িয়া আমার যে সর্ব্বস্ব গেল গো! ওগো আমার যে ঐ আধুলিটি বৈ পৃথিবীতে আর কিছু নাই গো! ওগো তা লইয়া মানুষে যে ঠাট্টা করে গো! 'ব্যাঙের আধুলি', 'ব্যাঙের আধুলি' বলিয়া মানুষে যে হিংসায় ফাটিয়া মরে গো! ওগো মা গো! আমার কি হ’ল গো!”

 ব্যাঙ পুনরায় আধ-কান্না সুরে ফুপিয়া-ফুপিয়া বলিলেন,— “ওগো! আমি যে মনে করিয়াছিলাম,— দুই দণ্ড বসিয়া তোমার সঙ্গে গল্পগাছা করিব গো! ওগো তা যে আর হইল না গো! ওগো আমার যে শোকসিন্ধু উথলিয়া উঠিল গো! ওগো তুমি ঔ দিক দিয়া যাও গো? তাহা হইলে লোকালয়ে পৌঁছিতে পারিবে গো! ওগো সে যে অনেক দূর গো! ওগো আজ সেখানে যাইতে পারিবে না গো! ওগো তোমরা যে আমাদের মত লাফাইতে পার না গো! ওগো তোমরা যে গুটি-গুটি চলিয়া যাও গো। ওগো তোমাদের চলন দেখিয়া, আমার যে হাসি পায় গো। ওগো তোমাদের চলন দেখিয়া, আমার যে কান্না পায় না গো! ওগো তুমি যে লোক ভাল গো; ওগো লেখাপড়া শিখিয়া তুমি যে মন্দ মেয়েমানুষ হওনি গো! ওগো তুমি যে ধীর, শান্ত, লজ্জাশীলা পতি-পরায়ণা গো! ওগো! তুমি যে মেয়েজ্যাটা নও গো! ওগো! আমার যে আধুলিটি এইবার জন্মের মত গেল গো! ওগো! আমার কি হইল গো!