ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
পচাজল
কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “একে আপনার দুঃখে মরি, তাহার উপর এ আবার এক জ্বালা! যাহা হউক, ব্যাঙের কান্না একটু থামিয়াছে, এইবার আমি যাই।”
ব্যাঙ যেরূপ বলিয়া দিলেন, কঙ্কাবতী সেই পথ দিয়া চলিলেন। চলিতে চলিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল, তবুও বন পার হইতে পারিলেন না। যখন সন্ধ্যা হইয়া গেল, তখন তিনি অতিশয় শ্রান্ত হইয়া পড়িলেন; আর চলিতে পারিলেন না। বনের মাঝখানে একখানি পাথরের উপর বসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
পাথরের উপর বসিয়া কঙ্কাবতী কাঁদিতেছেন, এমন সময় মৃদুমধুর তানে গুনগুন করিয়া কে তাহার কানে বলিল— “তোমরা কারা গা? তুমি কাদের মেয়ে গা?”
কঙ্কাবতী এদিক-ওদিক চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। অবশেষে দেখিতে পাইলেন যে, একটি অতি ক্ষুদ্র মশা তাহার কানে এই কথা বলিতেছে। মশাটিকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন যে, সেটি নিতান্ত বালিকা-মশা।
কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “আমি মানুষের মেয়ে গো! আমার নাম কঙ্কাবতী!”
মশা-বালিকা বলিলেন,— “মানুষের মেয়ে! আমাদের খাবার? বাবা যাদের রক্ত নিয়ে আসেন? খাই বটে, কিন্তু মানুষ কখনও দেখি নাই। আমরা ভদ্র মশা কিনা? তাই আমরা ওসব কথা জানি না! আমি কখনও মানুষ দেখি নাই। কিরূপ গাছে মানুষ হয়, তাহাও আমি জানি না। কৈ? দেখি দেখি। মানুষ আবার কিরূপ হয়!"
এই বলিয়া মশা-বালিকা, কঙ্কাবতীর চারিদিকে উড়িয়া উড়িয়া দেখিতে লাগিলেন।
ভাল করিয়া দেখিয়া, শেষে মশা বালিকা জিজ্ঞাসা করিলেন,—"তুই ধাড়ি মানুষ নও, বাচ্ছা মানুষ;—না?”
কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “নিতান্ত ছেলেমানুষ নই, তবে এখনও লোকে আমাকে বালিকা বলে।”
মশা-বালিকা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তোমার নাম কি বলিলে?”
কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “আমার নাম কঙ্কাবতী।”
মশা-বালিকা বলিলেন,— “ভাল হইয়াছে। আমার নাম রক্তবতী। ছেলেবেলা রক্ত খাইয়া পেটটি আমার টুপটুপে হইয়া থাকিত, বাবা তাই আমার নাম রাখিয়াছেন,— রক্তবতী! আমাদের দুইজনের নামে নামে বেশ মিল হইয়াছে, রক্তবতী আর কঙ্কাবতী। এস ভাই! আমরা দুইজনে কিছু একটা পাতাই।”
কঙ্কাবতী বলিলেন,— “আমি এখন বড় শোক পাইয়াছি, এখন ঘোর মনোদুঃখে আছি। আমি এখন পতিহারা সতী। তুমি বালিকা; সেসব কথা বুঝিতে পরিবে না। কিছু পাতাইয়া আহ্লাদ আমোদ করি, এখন আমার সে সময় নয়।”
রক্তবতী বলিলেন,— “তুমি পতিহারা সতী! তার জন্য আর ভাবনা কি? বাবা বাড়ী আসুন, বাবাকে আমি বলিব। বাবা তোমার কত পতি আনিয়া দিবেন। এখন এস ভাই। কিছু একটা পাতাই। কি পাতাই বল দেখি? আমি পচাজল বড় ভালবাসি! যেখানে পচাজল থাকে, মনের সুখে আমি সেইখানে উড়িয়া বেড়াই,— পচাজলের ধারে উড়িয়া উড়িয়া আমি কত খেলা