পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করি। তোমার সহিত আমি 'পচাজল' পাতাইব। তুমি আমার 'পচাজল', আমি তোমার 'পচাজল'! কেমন এখন মনের মতন হইয়াছে তো?”

 কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “ইহাদের সহিত তর্ক করা বৃথা। বুড়ো মিনসে ব্যাঙ, তারেই বড় বুঝাইয়া পারিলাম, তা এ তো একটা সামান্য বালিকা-মশা। ইহার এখনও জ্ঞান হয় নাই। ইহাদের যাহা ইচ্ছা হয় করুক, আর আমি কোনও কথা কহিব না।”

 কঙ্কাবতী দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন,— “আচ্ছা, তাহাই ভাল। আমি তোমার পচাজল, তুমি আমার পচাজল। হা জগদীশ্বর! হে হৃদয়দেবতা। তুমি কোথায়, আর আমি কোথায়! সেখানে তোমার কি দশা, আর এখানে আমার কি দশা।”

 এই কথা বলিয়া কঙ্কাবতী বারবার নিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন, আর কাঁদিতে লাগিলেন!

 পচাজলের দুঃখ দেখিয়া মশা-বালিকাটিরও দুঃখ হইল। মশা-বালিকাটি বুঝিতে পারেন না যে, তাঁর পচাজল এত কাঁদেন কেন? গুনগুন করিয়া কঙ্কাবতীর চারিদিকে তিনি উড়িয়া দেখিতে লাগিলেন।

 রক্তবতী বলিলেন,— “পচাজল! তোমার ভাই! আর দুটি পা কোথায় গেল? উপরের দুটি পা আছে, নীচের দুটি পা আছে, মাঝে দুটি পা কোথায় গেল? ভাঙ্গিয়া গিয়াছে বুঝি? ওঃ! সেইজন্য তুমি কাঁদিতেছ? তার আবার কান্না কি, পচাজল? খেলা করিতে করিতে আমারও একটি পা ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। এই দেখ, সে পা-টি পুনরায় গজাইতেছে। তোমারও পা সেইরূপ গজাইবে, চুপ কর,— কাঁদিও না।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “আমার পা ভাঙ্গিয়া যায় তোমাদের মত আমাদের পা নয়; খাবে কি দিয়া?”

 মশা-বালিকা কি বলিতেছে, কঙ্কাবতী তাহা প্রথম বুঝিতে পারিলেন না। পরে বুঝিলেন যে, সে শুঁড়ের কথা বলিতেছে। কঙ্কাবতী মনে করিলেন যে, “এ মশা-বালিকাটি নিতান্ত শিশু, এখনও ইহার কিছুমাত্র জ্ঞান হয় নাই।”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “আমাদের নাক এইরূপ। তোমাদের নাক যেরূপ দীর্ঘ, আমাদের নাক সেরূপ লম্বা নয়। আমরা নাক দিয়া খাই না, আমরা মুখ দিয়া খাই।”

 রক্তবতী বলিলেন,— “আহা! তবে পচাজল! তোমার কি দূরদৃষ্ট যে, আমার মত তোমার নাক নয়। এই বড় নাকে আমাকে কেমন দেখায় দেখ দেখি। জলের উপর গিয়া আমি আমার মুখখানি দেখি, আর মনে মনে কত আহ্লাদ করি। মা বলেন যে, 'বড় হইলে আমার রক্তবতী একটি সাক্ষাৎ সুন্দরী হইবে।' তা ভাই পচাজল! তোমাকেও আমি সুন্দরী করিব। বাবা বাড়ী আসিলে বাবাকে বলিব, তিনি তোমার নাকটি টানিয়া বড় করিয়া দিবেন। তখন তোমাকে বেশ দেখাইবে।”

 কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “আবার সেই নাকের কথা! নাক নাক করিয়া ইহারা সব সারা হইয়া গেল। কাঁকড়া নাকের কথা বলিয়াছিল, ব্যাঙ বলিয়াছিল; এই মশা-বালিকাও সেই কথা বলিতেছে। তারপর সেই নাকেশ্বরীর নাক! উঃ! কি ভয়ানক!”