পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কঙ্কাবতী আরও ভাবিতে লাগিলেন,— “এই ঘোর দুঃখের সময় আমি বড় বিপদেই পড়িলাম। কোথায় তাড়াতাড়ি গ্রামে গিয়া চিকিৎসক আনিয়া স্বামীর প্রাণরক্ষা করিব; না,— ওখানে ব্যাঙ, এখানে মশা,— সকলে মিলিয়া আমাকে বিষম জ্বালাতনে ফেলিল। ব্যাঙের হাত এড়াইতে না এড়াইতে মশার হাতে পড়িলাম। মশার একরতি মেয়েটি তো এই রঙ্গ করিতেছেন; আবার ইহার বাপ বাড়ী আসিয়া যে কি রঙ্গ করিবেন, তা তো বলিতে পারি না!”

 রক্তবতী বলিলেন,— “ঐ যে পাতাটি দেখিতেছ, পচাজল! যার কোণটি কুঁকড়ে রহিয়াছে? উহার ভিতর আমাদের ঘর! আমার মা’রা উহার ভিতরে আছেন। আমার তিন মা। বাবা চরিতে গিয়াছেন, বাবা এখনি কত খাবার আনিবেন। যাই, মাদের বলিয়া আসি যে, আমার পচাজল আসিয়াছে।”

 এই বলিয়া রক্তবতী ঘরের দিকে উড়িয়া গেলেন। অল্পক্ষণ পরে রক্তবতী পুনরায় ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন,— “পচাজল! মা তোমাকে ডাকিতেছেন। উঠ, চল, আমার মা'র সঙ্গে দেখা করিবে।”

 কঙ্কাবতী করেন কি? ধীরে ধীরে উঠিলেন। মশাদের ঘর, সেই কোঁকড়ানো পাতাটির কাছে যাইলেন।

 একটি নবীনা মশানী কুঞ্চিত পত্রকোণ হইতে ঈষৎ মুখ বাড়াইয়া বলিলেন,— “হাঁ গা বাছা। তুমি আমার রক্তবতীর সহিত পচাজল পাতাইয়াছ? তা বেশ করিয়াছ। রক্তবতী আমাদের বড় আদরের মেয়ে। কর্ত্তার এত বিষয়-বৈভব, তা আমার এই রক্তবতীই তার একমাত্র সন্তান। তা, হাঁ গা বাছা! রক্তবতী, কি তোমার পতির কথা বলতেছিল? কি হইয়াছে?”

কঙ্কাবতী কাঁদিতে কঁদিতে বললেন,— “ওগো আমি বড় দুঃখিনী! আমি বড় শোক পাইয়াছি। পৃথিবী আমি অন্ধকার দেখিতেছি। যদি আমার পতিকে না পাই, তবে এ ছার প্রাণ আমি কিছুতেই রাখিব না। আমার পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে। পতিকে বাঁচাইবার নিমিত্ত আমি লোকালয়ে যাইতেছি। সেখান হইতে ভাল চিকিৎসক আনিব, আমার স্বামীকে দেখাইব। তাই আমি বিলম্ব করিতে পারি না। পুনরায় আমি এই রাত্রিতেই পথ চলিব। কিন্তু আমি পথ জানি না, অন্ধকারে আমি পথ দেখিতে পাইব না। তোমরা আমাকে একটু যদি পথ দেখাইয়া দাও, তাহা হইলে আমার বড় উপকার হয়।”

 মশানী বলিলেন,— “ছেলেমানুষ, বালিকা তুমি, তোমার কোনও জ্ঞান নাই। একে আমরা স্ত্রীলোক, যে-সে মশার স্ত্রী নই, গণ্যমান্য সন্ত্রান্ত মশার স্ত্রী; তাতে আমরা পর্দানশীন, কুলবধূ। আমাদিগের কি ঘরের বাহিরে যাইতে আছে, বাছা? না,—আমরা পথঘাট জানি? তুমি কাঁদিও না। কর্ত্তা বাড়ী আসুন, কর্ত্তাকে আমি ভাল করিয়া বলিব। তুমি এখন আমাদের কুটুম্ব,— রক্তবতীর পচাজল। যাহা ভাল হয়, তোমার জন্য কর্ত্তা অবশ্যই করিবেন। তুমি একটু অপেক্ষা কর।”

 কঙ্কাবতীর সহিত যিনি এতক্ষণ কথা কহিতেছিলেন, তিনি রক্তবতীর মা;—মশার ছোটরাণী। এইবার মশার বড়রাণী পাশ দিয়া একটু মুখ বাড়াইলেন।

 বড়-মশানী বলিলেন,— “ওটা একটা মানুষের ছানা বুঝি? আমি ওরে পুষিব। আমার ছেলেপিলে নাই; অনেকদিন ধরিয়া আমার মনে সাধ আছে যে, জীবজন্তু কিছু একটা পুষি। তা ভাল হইয়াছে, ঐ মানুষের ছানাটা এখানে আসিয়াছে, ওটাকে আমি পুষিব। কিছু বড় হইয়া গিয়াছে সত্য— তা যাই হউক, এখনও পোষ মানিবার সময় আছে। মানুষে, শুনিয়াছি মেষ,

৯৪
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ