পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জগতে এবং সে-বাস্তবে সংশয়াতীতভাবে অমানবিকতা, ক্রুরতা ও ভণ্ডামির প্রাধান্য। গল্প কিছুদূর অগ্রসর হলে লেখক আমাদের যেখানে নিয়ে যান, তা সম্পূর্ণত রূপকথার জগৎ। আমরা যখন এ-কাহিনীকে বড়দের রূপকথা বলে প্রায় এবং আমরা জানতে পারি যে, যাকে আমরা বড়দের রূপকথা বলে এতক্ষণ ঠাহর করেছিলাম, আসলে তা জ্বরবিকারের ঘোরে দেখা একরকম স্বল্পজগতের ইতিবৃত্ত। ডমরু-চরিতে অনেক উপকরণ আছে যা অবিশ্বাস্য। গল্পের কথকের নির্বিকার মিথ্যা-ভাষণ বলে তার অনেকখানি চিহ্নিত করা যায়, তবে তার পরপরই আমরা উপলব্ধি করি যে, ঘটনা যদিও অবিশ্বাস্য পর্যায়ে চলে যায়, কিন্তু যে-মনোভাব অমন অবিশ্বাস্য ঘটনাকে প্রণোদিত করে, তার বাস্তব ভিত্তি আছে।

 এই বাস্তবতাবোধ এমন পর্যায়ের যে, প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, ‘পর্যবেক্ষণশক্তি যেমন ত্রৈলোক্যনাথের প্রচুর পরিমাণে ছিল কল্পনাশক্তি তেমন ছিল না।' কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে, মানবলোকে যা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাই আবার স্থাপন করেছেন অতিপ্রাকৃত জগতে। বস্তুত বাস্তব ও অবাস্তবের যে-সংমিশ্রণ তিনি ঘটিয়েছেন, তার মধ্যেই তাঁর কল্পনাশক্তির বিশেষত্বটি পরিস্ফুট হয়। সুকুমার সেনের মতে, কল্পনাশক্তি, সমবেদনা, মাত্রাজ্ঞান ও সরসতা—এইসব দুর্লভ গুণের সমাবেশ তাঁর রচনায় ঘটেছিল। তার ফলে, অদ্ভুত ও কৌতুক রসের মিলনে তাঁর রচনা অভিনব রূপ লাভ করেছিল। সুকুমার সেন অবশ্য মনে করেন যে, ত্রৈলোক্যনাথ কতকটা লুইস ক্যারলের আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু এ-কথা মনে হওয়া আরো সংগত যে, দেশীয় পরিস্থিতি ও আবহ এবং কাহিনী রচনায় দেশীয় ঐতিহ্যকেই তিনি মনে রেখেছিলেন বেশি। ত্রৈলোক্যনাথ কেবল অদ্ভুত ও অসম্ভবকে তুলে ধরেন নি, এসবের পেছনে কেবল কাহিনীকথনের ঝোঁক কার্যকর ছিল না; তিনি সমকালীন সমাজের কপটতা, স্বার্থপরতা ও হৃদয়হীনতাকে উদ্ঘাটন করেছেন, তার তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্যঙ্গে ও রঙ্গে।

 ধর্মীয় আচারপরায়ণতা যেখানে আচারসর্বস্বতায় পরিণত হয়, রীতি যখন নীতির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখন ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে গুরুতর অসংগতি দেখা দিতে বাধ্য। এই অসংগতি ত্রৈলোক্যনাথের লেখার প্রিয় বিষয়। সুশীলকুমার গুপ্ত উল্লেখ করেছেন যে, 'এমনকি যে স্বদেশী-দ্রব্যের উৎপাদন ও প্রচার সম্বন্ধে তিনি সারাজীবন চেষ্টা করিয়াছিলেন সেই স্বদেশীদ্রব্য প্রস্তুতি-প্রণালী লইয়াও তিনি রসিকতা করিতে ছাড়েন নাই।' তবে তাঁর গুরুতর ক্রোধ অন্যত্র। তাঁর যে-চরিত্র বলে 'লোকে পাছে অলস হইয়া পড়ে, সেই ভয়ে ভিখারীকে কখন মুষ্টিভিক্ষা প্রদান করি না', কিংবা যে দু'আনা বেশি পাওয়ার লোভে জীবন্ত ছাগলের ছাল ছাড়ায়, কিংবা যে-ব্যক্তি মদ্যপানের অগৌরব কপালে ফোঁটা দিয়ে ঢাকতে চায়, কিংবা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েও যে-ব্যক্তি গোরক্ত দিয়ে তৈরি-করা বরফ খাওয়া সম্পর্কে নিতান্ত কটুক্তি করে, কিংবা যে-নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ পাঠীর মাংস বিক্রি করতে দ্বিধা