পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নিকট কথা গোপন করিতেছ! তোমার ভয় নাই, তুমি সত্য সত্য আমার কথার উত্তর দাও। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি,— তুমি কোন মশার সম্পত্তি, কোন মশা তোমার গায়ে উপবিষ্ট হইয়া রক্তপান করেন? তাহার নাম কি? তাহার নিবাস কোথায়? তাঁহার কয় স্ত্রী? কয় পুত্র? কয় কন্যা? পৌত্র-দৌহিত্র আছে কি না? তাহার জ্ঞাতি-বন্ধুদিগের তোমার উপর কোনও অধিকার আছে কি না? তাহারা তোমাকে এজেমালিতে রাখিয়াছেন, কি তোমার হস্তপদাদি বণ্টন করিয়া লইয়াছেন? যদি তুমি বণ্টিত হইয়া থাক, তাহা হইলে সে বিভাগের কাগজ কোথায়? মধ্যস্থ দ্বারা তুমি বণ্টিত হইয়াছ, কি আদালত হইতে আমীন আসিয়া তোমাকে বিভাগ করিয়া দিয়াছে? এইসব কথার তুমি আমাকে সঠিক উত্তর দাও! কারণ, আমি তোমাকে কিনিয়া লইবার বাসনা করি। আমার তালুকে অনেক মানুষ আছে, মানুষের অভাব নাই। আমার সম্পত্তি নরনারীগণের দেহে যা রক্ত আছে, তাহাই খায় কে? তবে তুমি রক্তবতীর সহিত 'পচাজল' পাতাইয়াছ, সেইজন্য তোমাকে আমি একবারে কিনিয়া লইতে বাসনা করি। তাহা যদি না করি, তাহা হইলে তোমার অধিকারী মশাগণ আমার নামে আদালতে অভিযোগ উপস্থিত করিতে পারেন। তোমাকে এখান হইতে তাঁহারা পুনরায় লইয়া যাইতে পারেন। আমার রক্তবতী তাহা হইলে কাঁদিবে। আমি আর একটি কথা বলি, এরূপ করিয়া এক গ্রাম হইতে আর এক গ্রামে ভারতবাসীদিগের যাওয়া উচিত নয়। ভারতবাসীদিগের উচিত, আপন আপন গ্রামে বসিয়া থাকা। তাহা করিলে, মশাদিগের মধ্যে সম্পত্তি লইয়া আর বিবাদ হয় না। মশাগণ আপনি আপনি সম্পত্তি সুখে-স্বচ্ছন্দে সম্ভোগ করিতে পারেন! শীঘ্রই আমরা ইহার একটা উপায় করিব। এক্ষণে আমার কথার উত্তর দাও! এখন বল, তোমার মশা-প্রভুর নাম কি?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “মহাশয়! আমি মৃত্যু সত্য বলিতেছি, আমার মশা-প্রভুর নাম আমি জানি না। মনুষ্যেরা যে মশাদিগের সম্পত্তি, তাহাও আমি জানিতাম না। মশাদিগের মধ্যে যে মানুষেরা বিতরিত, বিক্রীত, ও বণ্টিত হইয়া থাকে, তাহাও আমি জানিতাম না। মশাদিগের যে আবার নাম থাকে, তাহাও আমি জানি না। তা আমি কি করিয়া বলি যে, আমি কোন মশার সম্পত্তি।”

 ক্রোধে মশা প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। রাগে তাঁহার নয়ন আরক্ত হইয়া উঠিল। মশা বলিলেন,— “না, তুমি কিছুই জান না! তুমি কচি খুকীটি! গায়ে কখনও মশা বসিতে দেখ নাই! সে মশাগুলিকে তুমি চেন না! তাহাদের তুমি নাম জান না! তুমি ন্যাকা। পতিহারা সতী হইয়া কেবল পথে পথে কাঁদিতে জান!”

 মশার এইরূপ তাড়নায় কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিলেন। কঙ্কাবতীর পানে চাহিয়া, রক্তবতী চক্ষু টিপিলেন। সে চক্ষু টিপুনীর অর্থ এই যে,— “পচাজল! তুমি কঁদিও না। বাবা বড় রাগী মশা! একে রাগিয়াছেন, তাতে তুমি কাঁদিলে আরও রাগিয়া যাইবেন। চুপ কর, বাবার রাগ এখনি যাইবে।”

 রক্তবতী যা বলিলেন, তাই হইল। কঙ্কাবতীর কান্না দেখিয়া মশা আরও রাগিয়া উঠিলেন। মশা বলিলেন,— “এ কোথাকার প্যানপেনে মেয়েটা র্য্যা। ভ্যানোর ভ্যানের করিয়া কাঁদে দেখ। আচ্ছা। যেসব কথা এতক্ষণ ধরিয়া জিজ্ঞাসা-পড়া করিলাম, তার তুমি কিছুই জান না, বলিলে! এখন একথাটার উত্তর দিতে পরিবে কি না? ভাল এই যেসব মানুষ হইয়াছে, এই যে কোটি কোটি মানুষ ভারতে রহিয়াছে, এসব মানুষ কেন? কিসের জন্য সৃজিত হইয়াছে? একথার এখন আমাকে উত্তর দাও।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মানুষ কেন, কিসের জন্য সৃজিত হইয়াছে? তা, আমি জানি না।”

৯৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ