পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যাই। মহাময়! স্বামী-শোকে শরীর আমার প্রতিনিয়তই দগ্ধ হইতেছে, সংসার আমি শূন্য দেখিতেছি। তাঁহার প্রাণরক্ষা হইবে, কেবল এই প্রত্যাশায় জীবিত আছি। তা না হইলে, কোন কালে এ পাপ প্রাণ বিসৰ্জ্জন দিতাম।”

 মশা বলিলেন,— “অধিক রাত্রি হইয়াছে, তুমি পরিশ্রান্ত হইয়াছ। আমার তালুক নিতান্ত নিকট নয়। তবে রও! আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ডাকিতে পাঠাই। তাহার পিঠে চড়িয়া আমরা সকলে এখনি খর্ব্বুর মহারাজের নিকট গমন করিব।”

 মশা এই বলিয়া আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। কিছুক্ষণ বিলম্বে মশার ছোটভাই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মশানীগণ তাঁহাকে 'হাতি-ঠাকুর-পো, হাতি-ঠাকুর-পো' বলিয়া অনেক সমাদর ও নানারূপ পরিহাস করিতে লাগিলেন।

 রক্তবতী তাঁহাকে বলিলেন,— “কাকা! আমি একটি মানুষের ছানা পাইয়াছি। তাহার সঙ্গে আমি পচাজল পাতাইয়াছি। আমি পচাজলকে বড় ভালবাসি, আমার পচাজলও আমাকে বড় ভালবাসে।”

 কঙ্কাবতী আশ্চর্য্য হইলেন! মশার ছোটভাই, হাতী! প্রকাণ্ড হস্তী! বনের সকলে তাঁহাকে 'হাতি-ঠাকুর-পো' বলিয়া ডাকে।

 রক্তবতীর পিতা হস্তীকে বলিলেন,— “ভায়া! আমি বড় বিপদে পড়িয়াছি। রক্তবতী একটি মানুষের মেয়ের সহিত পচাজল পাতাইয়াছে। মেয়েটির পতিকে নাকেশ্বৱী খাইয়াছে। মেয়েটি পথে পথে কাঁদিয়া বেড়াইতেছে! রক্তবতীর দয়ার শরীর। রক্তবতী তাঁহার দুঃখে বড় দুঃখী! আমি তাই মনে করিয়াছি, যদি কোনও মতে পারি তো তাহার স্বামীকে উদ্ধার করিয়া দিই। খর্ব্বুর মহারাজের দ্বারাই এ কার্য্য সাধিত হইতে। তাই আমার ইচ্ছা যে, এখনি খর্ব্বুরের নিকট যাই। কিন্তু মানুষের মেয়েটি পথ হাঁটিয়া ও কাঁদিয়া কাঁদিয়া অতিশয় শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে। এত পথ সে চলিতে পারিবে না। এখন ভায়া, তুমি যদি কৃপা কর, তবেই হয়। আমাদিগকে যদি পিঠে করিয়া লইয়া যাও তো বড় উপকার হয়।”

 হাতি-ঠাকুর-পো সে কথায় সম্মত হইলেন। কঙ্কাবতী মশানীদের নমস্কার করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।

 রক্তবতীর গলা ধরিয়া কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ভাই পচাজল, তুমি আমার অনেক উপকার করিলে। তোমার দয়া তোমার ভালবাসা, কখনও ভুলিতে পারিব না। যদি ভাই পতি পাই, তবে পুনরায় দেখা হইবে। তা না হইলে, ভাই, এ জনমের মত তোমার পচাজল এই বিদায় হইল!”

 রক্তবতীর চক্ষু ছলছল করিয়া আসিল, রক্তবতীর চক্ষু হইতে অশ্রুবিন্দু ফোঁটায় ফোঁটায় ভূতলে পতিত হইতে লাগিল।

 মশা ও কঙ্কাবতী দুইজনে হাতীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। হাতি-ঠাকুর-পো মৃদুমন্দ গতিতে চলিতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে সমস্ত রাত্রি গত হইয়া গেল। অতি প্রত্যুষে খর্ব্বুরের বাটীতে গিয়া সকলে উপস্থিত হইলেন। তাহারা দেখিলেন যে, খর্ব্বুর শয্যা হইতে উঠিয়াছেন। অতি বিষণ্ন-বদনে আপনার দ্বারদেশে বসিয়া আছেন। একটু একটু তখনও অন্ধকার রহিয়াছে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষীয় প্রতিপদের চন্দ্র তখনও অস্ত যান নাই। খর্ব্বুরের বিষণ্ন-মূর্ত্তি দেখিয়া আকাশের চাঁদ অতি প্রসন্ন-মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছেন। চাঁদের মুখে আর হাসি ধরে না। চাঁদের হাসি দেখিয়া খর্ব্বুরের রাগ হইতেছে। খর্ব্বুর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন,— “এই চাঁদের একদিন আমি দণ্ড করিব। চাঁদকে যদি উচিত মত দণ্ড না দিতে পারি, তাহা হইলে, খর্ব্বুরের গুণজ্ঞান, তুকতাক মন্ত্র-তন্ত্র, শিকড়-মাকড়, সবই বৃথা।”

 মশা, কঙ্কাবতী ও হস্তী গিয়া খর্ব্বুরের দ্বারে উপস্থিত হইলেন। মশাকে দেখিয়া খর্ব্বুর

১০২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ