পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 নাকেশ্বরী ব্যস্ত হইয়া বলিল,— “মাসি! সর্ব্বনাশ হইল। মুখের গ্রাস বুঝি কাড়িয়া লয়! ছুড়ি বুঝি ওঝা আনিয়াছে।”

 মাসী বলিলেন,— “চল চল চল! দ্বারের উপর দুইজনে পা ফাঁক করিয়া দাঁড়াই!”

 অট্টালিকার দ্বারের উপর নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী পদপ্রসারণ করিয়া দাঁড়াইল। পর্ব্বতের ধারে সুড়ঙ্গের দ্বারে উপস্থিত মশা, কঙ্কাবতী ও খর্ব্বুর হস্তীর পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিলেন। হাতি-ঠাকুর-পো বাহিরে দণ্ডায়মান থাকিয়া গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া মাছি তাড়াইতে লাগিলেন। কখনও বা শুড়ে করিয়া ধূলারাশি লইয়া আপনার গায়ে পাউডার মাখিতে লাগিলেন। দোল খাইতে ইচ্ছা হইলে কখনও বা মনের সাধে শরীর দোলাইতে লাগিলেন।

 মশা, কঙ্কাবতী ও খর্ব্বুর সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করিলেন। সুড়ঙ্গের পথ দিয়া অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিবার সময় দ্বারে নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসীর পদতল দিয়া সকলকে যাইতে হইল।

 ভিতরে প্রবেশ করিয়া, খেতুর নিকট সকলে গমন করিলেন। সকলে দেখিলেন যে, খেতু মৃতপ্রায় হইয়া পড়িয়া রহিয়াছেন। অজ্ঞান অচৈতন্য। শরীরে প্রাণ আছে কি না সন্দেহ। নিশ্বাসপ্রশ্বাস বহিতেছে কি না সন্দেহ। কঙ্কাবতী তাঁহার পদপ্রান্তে পড়িয়া পা-দুটি বুকে লইয়া নানারূপ বিলাপ করিতে লাগিলেন। খর্ব্বুর খেতুকে নানা প্রকারে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন।

 অবশেষে খর্ব্বুর বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তুমি কাঁদিও না। তোমার পতি এখনও জীবিত আছেন। সত্বর আরোগ্যলাভ করিবেন। আমি এইক্ষণেই এ রোগের প্রতিকার করিতেছি।”

 এই বলিয়া খর্ব্বুর মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন, খেতুর শরীরে শত শত ফুৎকার বর্ষণ করিতে লাগিলেন, নানারূপ ঔষধ প্রয়োগ করিলেন। কিন্তু কোন ফল হইল না। সংজ্ঞাশুন্য হইয়া খেতু যেভাবে পড়িয়া ছিলেন, সেইভাবেই পড়িয়া রহিলেন। তিলমাত্রও নড়িলেন-চড়িলেন না।

 খর্ব্বুর বিস্মিত হইয়া বলিলেন,— “এ কি হইল! আমার মন্ত্র-তন্ত্র এরূপ। কখনও তো বিফল হয় না! রোগী পুনর্জ্জীবিত হউক না হউক, মন্ত্রের ফল অল্পাধিক অবশ্যই প্রকাশিত হইয়া থাকে। আজ যে আমার মন্ত্র-তন্ত্র শিকড়-মাকড় একেবারেই নিরর্থক হইতেছে, ইহার কারণ কি?”

 খর্ব্বুর সাতিশয় চিন্তিত হইলেন। ভাবিয়া কারণ কিছু স্থির করিতে পারেন না। অবশেষে তিনি বলিলেন,— “মহাপ্রভু! আসুন দেখি, সকলে পুনরায় বাহিরে যাই! বাহিরে গিয়া দেখি, ব্যাপারখানা কি?”

 অট্টালিকা হইতে সকলে পুনর্ব্বার বাহির হইলেন। কঙ্কাবতী একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন। কঙ্কাবতী ভাবিলেন যে, অভাগিনীর কপালে পতি যদি বাঁচিবেন, তবে এত কাণ্ড হবেই বা কেন? তবে এখন তিনি পতিদেহ পাইবেন, অসীম শোকসাগরে ভাসমান থাকিয়াও সে চিন্তাটি কথঞ্চিৎ তাহার শান্তির কারণ হইল।

 একবার বাহিরে যাইয়া, সুড়ঙ্গের পথ দিয়া সকলে পুনরায় ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন। অতি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে, আশপাশ, অগ্রপশ্চাৎ, উৰ্দ্ধ-নিম্ন দশদিক সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মরূপে পরীক্ষা করিতে করিতে খর্ব্বeর আসিতে লাগিলেন। অট্টালিকার নিকট আসিয়া উর্দ্ধদিকে চাহিয়া দেখেন যে, ভূতিনীদ্বয় পদপ্রসারণ করিয়া দ্বারের উপর দাঁড়াইয়া আছে। খর্ব্বুর ঈষৎ হাসিলেন; আর মনে মনে করিলেন,— “বটে! তোমাদের চাতুরী তো কম নয়!”

 এবার বাহির হইতে খর্ব্বুর মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। মন্ত্রের প্রভাবে ভূতিনীদ্বয় পদ উত্তোলন করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করিল। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া খর্ব্বুর পুনরায় ঝাড়ান-কাড়ান আরম্ভ করিলেন। ক্রমে মন্ত্রবলে নাকেশ্বরী আসিয়া খেতুর শরীরে আবির্ভূত হইল। খেত

১০৬
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ