পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করে না—এরাই ত্রৈলোকন্যাথের কথারাজ্যের অধিবাসী। সতীদাহ কি সমুদ্রযাত্রা সম্পর্কেও এমন সব চিত্তাকর্ষক উক্তি আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি টাইপই সৃষ্টি করে গেছেন, ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যপূর্ণ মানবচরিত্র তেমন আঁকেন নি। চরিত্রাঙ্কণে তিনি বিশেষভাবে দক্ষ।

 ত্রৈলোক্যনাথের আক্রমণের লক্ষ্য কেবল ব্যক্তি নয়, সমষ্টিও। তাই তিনি বলছেন, ‘কিছু একটা হুজুগ লইয়া বাঙ্গালী অধিক দিন থাকিতে পারে না। হুজুগ একটু পুরাতন হইলেই বাঙ্গালী পুনরায় নূতন হুজগের সৃষ্টি করে। অথবা এই বঙ্গভূমির মাটীর গুণে আপনা হইতেই নূতন হুজুগের উৎপত্তি হয়।’ কিন্তু সবার উপরে স্থান পাওয়ার মতো কথা ত্রৈলোক্যনাথের যম বলেছেন চিত্রগুপ্তকে: ‘পৃথিবীতে গিয়া মানুষ কি কাজ করিয়াছে, কি কাজ না করিয়াছে, তাহার আমি বিচার করি না। মানুষ কি খাইয়াছে, কি না খাইয়াছে, তাহার আমি বিচার করি। ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা, স্ত্রী-হত্যা করিলে এখন মানুষের পাপ হয় না, অশাস্ত্রীয় খাদ্য খাইলে মানুষের পাপ হয়।’ অধিক দৃষ্টান্ত নিষ্প্রয়োজন। এই কারণে অজিত দত্ত বলেছেন, ‘সর্বকালের মানবমনের শ্রেষ্ঠাংশের কাছেই তার [ত্রৈলোক্যনাথের রচনার] আবেদন।’

 ত্রৈলোক্যনাথের রচনারীতির মৌলিকতাও আমাদের মুগ্ধ করে। তিনি কাহিনী বর্ণনা করেন বৈঠকি ঢঙে—যেন শ্রোতাকে সামনে রেখে কথা বলছেন। এই কথকতার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসাধারণ। তাঁর ভাষা সরল, সহজ, অনাড়ম্বর। ‘লেখ্য ভাষাকে কথ্যভাষার সঙ্গে এমনভাবে মিলাইয়া দিতে অল্প লেখকই পারিয়াছেন।’ আশা করা যায়, ভাষা ও ভঙ্গির এই অনায়াসস্বাচ্ছন্দ্য, অপ্রাকৃতের মধ্যেও একটা নিয়মের অনুসরণ এবং নিষ্ঠ জীবন-সমালোচনা কালান্তরেও পাঠককে আকর্ষণ করবে।

বাংলা বিভাগ
আনিসুজ্জামান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৩০ জানুয়ারি ২০০১