পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

খুদে-পিঁপড়েদের কথা জানি। তালতলায় কচুপাত হইতে মানুষের সুমিষ্ট পরমায়াটুকু চাটিয়া-চুটিয়া খাইয়া, হাত-মুখ পুঁছিয়া, খুদে-পিঁপড়েরা গৃহে গমন করিতেছিল। এমন সময় সাহেবের পোষাক-পরা একটি ব্যাঙ আসিয়া তাহাদিগকে কুপ-কুপ করিয়া খাইয়া ফেলিল।”

 অট্টালিকায় প্রত্যাগমন করিয়া নাকেশ্বরী এই সংবাদটি খর্ব্বুরকে দিল। ভেকের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত খর্ব্বুর পুনরায় নাকেশ্বরীকে পাঠাইলেন। নাকেশ্বরী মনে করিল,— “ভাল কথা? আমার মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইবে, আবার সেই কাজে আমাকেই খাটাইবে।” কিন্ত নাকেশ্বরী করে কি? কথা না শুনিলেই খর্ব্বুর সেই কুমড়াটি বলিদান দিবেন। এদিকে তিনি কুমড়াটি কাটিবেন, আর ওদিকে নাকেশ্বরীর গলাটি দুইখানা হইয়া যাইবে।

 বনে বনে, পথে পথে, পর্ব্বতে পর্ব্বতে, খানায় ডোবায়, নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী ভেকের অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতে লাগিলেন! কোথায়, কোন গর্ত্তের ভিতর ব্যাঙ খাইয়া-দাইয়া বসিয়া আছেন, তাহার সন্ধান ভূতিনীরা কি করিয়া পাইবে? ব্যাঙের কোনও সন্ধান হইল না। নাকেশ্বরী ফিরিয়া আসিয়া খর্ব্বুরকে বলিল,— “আমাকে মারুন, আর কাটুন, ব্যাঙের সন্ধান আমি কিছুতেই করিতে পারিলাম না।”

 নাকেশ্বরীর কথা শুনিয়া খর্ব্বুর পুনরায় ঘোর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া অবশেষে তিনি একমুষ্টি সর্ষপ হাতে লইলেন। মন্ত্রপূত করিয়া সরিষাগুলিকে ছড়াইয়া ফেলিলেন। পড়া সরিষেরা নক্ষত্রবেগে পৃথিবীর চারিদিকে ছুটিল, দেশ-বিদেশ, গ্রাম-নগর, উপত্যকা-অধিত্যকা, সাগর-মহাসাগর চারিদিকে খর্ব্বুরের সরিষা-পড়া ছুটিল। পণপূর্ণ, পুরাতন, পঙ্কিল পুষ্করিণীর পার্শ্বে, সুশীতল গর্ত্তের ভিতর ব্যাঙ মহাশয় মনের সুখে নিদ্রা যাইতেছিলেন। সরিষাগণ সেইখানে গিয়া উপস্থিত ইহল। সূচের সূক্ষ্ম ধারে চর্ম্ম-মাংস ভেদ করিয়া সরিষাগণ ব্যাঙের মস্তকে চাপিয়া বসিল। ভেকের মাথা হইতে সাহেবী টুপিটি খসিয়া পড়িল। যাতনায় ব্যাঙ মহাশয় ঘোরতর চীৎকার করিতে লাগিলেন। ঠেলিয়া ঠেলিয়া সরিষার তাঁহাকে গর্ত্তের ভিতর হইতে বাহির করিল। ঠেলিয়া ঠেলিয়া তাঁহাকে অট্টালিকার দিকে লইয়া চলিল। ঠেলিয়া ঠেলিয়া তাঁহাকে সুড়ঙ্গের পথে প্রবিষ্ট করিল। অট্টালিকার সম্মুখে আসিয়া ব্যাঙ মহাশয় হস্ত দ্বারা দ্বারে আঘাত করিলেন।

 মশা দ্বার খুলিয়া দিলেন, ভেক মহাশয় অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিয়া যেখানে কঙ্কাবতী ও খর্ব্বুর বসিয়াছিলেন, সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কঙ্কাবতী চিনিলেন যে, এ সেই ব্যাঙ! ব্যাঙ চিনিলেন যে, এ সেই কঙ্কাবতী।

 ব্যাঙ বলিলেন,— “ওগো ফুটুফুটে মেয়েটি! তোমার সহিত এত আলাপ-পরিচয় করিলাম, আর তুমি আসিয়া সকলকে আমার আধুলিটির সন্ধান বলিয়া দিলে গা! ছিঃ! বাছা! তুমি এ ভাল কাজ করা নাই। ধনের গল্প গাঁটকাটাদের কাছে কি করিতে আছে? বিশেষতঃ ঐ চেপ্টা গাটকাটার কাছে। আমার আধুলির যাহা কিছু বাকী আছে, সকলে ভাগ করিয়া লও, লইয়া আমাকে এখন ছাড়িয়া দাও। চেপ্টা মহাশয়! আমি দেখিতেছি, এ সরিষাগুলি আপনার চেলা। এখন কৃপা করিয়া সরিষাগুলিকে আমার মাথাটি ছাড়িয়া দিতে বলুন। ইহাদের যন্ত্রণায় আমার প্রাণ বাহির হইতেছে!”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “তোমার আধুলিতে আমাদের প্রয়োজন কি? এ বালিকাটি তোমার পরিচিত। বালিকাটি কি ঘোর বিপদে পতিত হইয়াছে, তাহাও বোধ হয় তুমি জান। ঐ যে মৃত্যুবৎ যুবাটিকে দেখিতেছি, উনিই ইহার পতি। নাকেশ্বরী দ্বারা উনি আক্রান্ত হইয়াছেন। নাকেশ্বরী ওর পরমায়ু লইয়া তালবৃক্ষের মস্তকে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। বাতাসে সেই

১০৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ