পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ রোগের অব্যর্থ মহৌষধ; সেবন করাইলে এখনি ভেকের বমন হইবে।

 মশাকে সম্বোধন করিয়া খর্ব্বুর কহিলেন,— “মহাশয়! এ ব্যাঙের বমন হয়, এরূপ ঔষধ পৃথিবীতে নাই। জগতে ইহার কেবল একমাত্র ঔষধ আছে। ঐ যে আকাশে চাঁদ দেখিতে পান, ঐ চাঁদের মূল-শিকড়ের ছাল একতোলা, সাতটি মরিচ দিয়া বাটিয়া খাইলে, তবেই ব্যাঙের বমন হইবে, নতুবা আর কিছুতেই হইবে না।”

 এই কথা শুনিয়া মশা বিমর্ষ হইয়া রহিলেন। কঙ্কাবতী একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন। কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মশা মহাশয়! খর্ব্বুর মহারাজ! এই হতভাগিনীর জন্য আপনারা অনেক পরিশ্রম করিলেন। কিন্তু আপনারা কি করিবেন? এ হতভাগিনীর কপাল নিতান্তই পুড়িয়াছে। আকাশে গিয়া চাঁদের মূল-শিকড় কে কাটিয়া আনিতে পারে? চাঁদের মূল-শিকড়ও সংগ্রহ হইবে না, পতিও আমার প্রাণ পাইবেন না। আপনারা সকলে গৃহে প্রত্যাগমন করুন, আমার জন্য বৃথা আর ক্লেশ পাইবেন না। আপনাদিগের অনুগ্রহে আমি যে, আমার পতির মৃতদেহটি পাইলাম, তাহাই যথেষ্ট। পতির পদ আশ্রয় করিয়া আমি এক্ষণে প্রাণ পরিত্যাগ করি। আপনারা সকলে গৃহে প্রত্যাগমন করুন।”

 মশা বলিলেন,— “আমি অনেক দূর উড়িতে পারি সত্য। কিন্তু চাঁদ পর্যন্ত যে উড়িয়া যাই, এরূপ শক্তি আমার নাই। সেজন্য আমি দেখিতেছি যে, আমাদের সমুদয় পরিশ্রম বিফল হইল। আহা! রক্তবতী মা আমার পথপানে চাহিয়া আছেন! রক্তবতীকে গিয়া কি বলিব?”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “আপনারা নিতান্ত হতাশ হইবেন না। একটি খোক্কোশের বাচ্ছার সন্ধান হয়? তাহা হইলে, তাহার পিছে চড়িয়া অনায়াসেই আকাশে উঠিতে পারা যায়। ধাড়ী খোক্কোশ যে তোমাদিগকে একগালে খাইয়া ফেলিবে? আচ্ছা, যেন পাকে প্রকারে তাহাকে ধরিলে। তাহার পিঠে চড়িয়া আকাশের উপর যায় কে? প্রাণটি হাতে করিয়া আকাশে যাইতে হইবে। আকাশে ভয়ানক সিপাহী আছে, আকাশের সে চৌকিদার। কর্ণে সে বধির! কানে ভাল শুনিতে পায় না বটে, কিন্তু অন্যদিকে সে বড়ই দুৰ্দান্ত সিপাহী। আকাশের লোক তাহার ভয়ে সব জড়সড়। আকাশের চারিদিকে সে পাহারা দিয়া বেড়ায়, তাহার হাতে পড়িলে আর রক্ষা নাই। তাই ভাবিতেছি, চাঁদের মূল-শিকড় কাটিয়া আনিতে আকাশে যায় কে?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “সেজন্য আপনাদিগের কোনও চিন্তা নাই। যদি খোক্কোশের বাচ্ছা পাই, তাহা হইলে তাহার পিঠে চড়িয়া আমি আকাশে যাইব। আমার আর ভয় কিসের? যদি আকাশে সিপাহীর হাতে পড়ি, সে না হয় আমাকে মারিয়া ফেলিবে, আর আমার সে কি করিতে পারে? পতি বিহনে আমি তো এ প্রাণ রাখিব না, এ তো আমার একান্ত প্রতিজ্ঞা! তবে প্রাণের ভয় আর কি জন্য করিব?”

 এখন খোক্কোশের বাচ্ছা ধরাই স্থির হইল! যে পাহাড়ের ধারে, গর্ত্তের ভিতর খোক্কোশের বাচ্ছা হইয়াছে, ব্যাঙ তাহার সন্ধান বলিয়া দিলেন। মশা বলিলেন,— “কৌশল করিয়া খোক্কোশের বাচ্ছা ধরিতে হইবে।”

 এইরূপ স্থির হইল যে, ব্যাঙ ও খর্ব্বুর অট্টালিকায় খেতুকে চৌকি দিয়া বসিয়া থাকিবেন, আর মশা, কঙ্কাবতী ও হাতি-ঠাকুর-পো খোক্কোশের বাচ্ছা ধরিতে যাইবেন।

 যাত্রা করিবার সময় কঙ্কাবতী, খেতুর পদধূলি লইয়া আপনার মস্তকে রাখিলেন।

১১০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ