পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

খোক্কোশের প্রাণ উড়িয়া গেল। খোক্কোশ ভাবিল,— “তোদের মাথার উকুন আসিয়া তো আমার বাচ্ছাটিকে ধরিল, ঘোক্কোশেরা নিজে আসিয়া আমাকে না ধরে!” এই মনে করিয়া খোক্কোশ বাচ্ছা ফেলিয়া উড়িয়া পলাইল।

 মশা ও কঙ্কাবতী তখন সেই গর্ত্তের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 মশা বলিলেন,— “কঙ্কাবতী। তুমি এখন ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ কর। খোক্কোশ-শাবকের পিঠে চড়িয়া তুমি এখন আকাশে গিয়া উঠ, চাঁদের শিকড় লইয়া পুনরায় এইখানে আসিবে। তোমার প্রতীক্ষায় এইখানে আমরা বসিয়া রহিলাম। তুমি আসিলে, আমরা খোক্কোশের বাচ্ছাটিকে ফিরিয়া দিব। কারণ, এখনও এ স্তন্যপান করে, অতি শিশু; ইহাকে লইয়া আমরা কি করিব? যাহা হউক, তুমি এখন আকাশের দোর্দণ্ড সিপাহীর হাত হইতে রক্ষা পাইলে হয়। শুনিয়াছি, সে অতি ভয়ঙ্কর দোর্দণ্ড-প্রতাপান্বিত সিপাহী। সাবধানে আকাশে উঠিবে।”

 আকাশপানে চাহিয়া মশা পুনরায় বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! আমার কিছু আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। আজ দ্বিতীয়ার রাত্রি, চাঁদ উঠিবার সময় অনেকক্ষণ উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু চাঁদও দেখিতে পাই না, নক্ষত্রও দেখিতে পাই না। অথচ মেঘ করে নাই। কালো মেঘে না ঢাকিয়া, সমস্ত আকাশ বরং শুভ্রবর্ণ হইয়াছে; ইহার অর্থ আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। ইহার কারণ কি? আকাশে উঠিলে হয়তো তুমি বুঝিতে পরিবে। অতি সাবধানে আপনার কার্য্য উদ্ধার করিবে।”

 কঙ্কাবতী খোক্কোশ-শাবকের পিঠে চড়িয়া আকাশের দিকে তাহাকে পরিচালিত করিলেন, দ্রুতবেগে খোক্কোশ-শাবক উড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতী অবিলম্বে আকাশের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন।

 আকাশের কাছে গিয়া কঙ্কাবতী দুয়ে সমুদয় আকাশে চূণখাম করা। কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “এ কি প্রকার কথা। পর এরূপ চুণখাম করিয়া কে দিলো?”

 আকাশের উপর উঠিতে কঙ্কাবতী আর পথ পান না। যেদিকে যান, সেইদিকেই দেখেন চুন-খাম। আকাশের একধার হইতে অন্য ধারা পর্যন্ত ঘুরিয়া বেড়াইলেন, পথ কিছুতেই পাইলেন না! সব চূণখাম। কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “ঘোর বিপদ! আকাশের উপর এখন উঠি কি করিয়া?”

 হতাশ হইয়া, আকাশের চারিধারে কঙ্কাবতী পথ খুঁজিতে লাগিলেন। অনেক অন্বেষণ করিয়া, সহসা একস্থানে একটি সামান্য ছিদ্র দেখিতে পাইলেন। সেই ছিদ্রটি দিয়া নক্ষত্রদের বৌ উঁকি মারিতেছিল। কঙ্কাবতী সেই ছিদ্রটির নিকট যাইলেন। কঙ্কাবতীকে দেখিয়া নক্ষত্রদের বৌ একবার লুকাইল, পুনরায় আবার ভয়ে ভয়ে উঁকি মারিতে লাগিল।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ওগো নক্ষত্রদের বৌ! তোমার কোন ভয় নাই! আমিও মেয়েমানুষ, আমাকে দেখিয়া আবার লজ্জা কেন বাছা!”

 নক্ষত্রদের বৌ উত্তর করিল,— “কে গা মেয়েটি তুমি? তোমার কথাগুলি বড় মিষ্ট! অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতেছি, তুমি চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তাই মনে করিলাম, তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, কি তুমি খুজিতেছি? কিন্তু হাজার হউক, আমি বৌমানুষ, সহসা কি কাহারও সঙ্গে কথা কহিতে পারি? তাতে রাত্রিকাল! একটু আস্তে কথা কও, বাছা! আমার ছেলেপিলেরা সব শুয়েছে, এখনি জাগিয়া উঠিবে, কাচা ঘুম ভাঙ্গিলে কাঁদিয়া জ্বালাতন করিবে।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ওগো! নক্ষত্রদের বৌ। আমার নাম কঙ্কাবতী! আমি পতিহারা সতী!

১১৪
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ