পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অবশেষে মশা বলিলেন,— “মা, উঠ। বিলাপে আর কোনও ফল নাই। তোমার পতির এক্ষণে আমরা যথাবিধি সৎকার করি। তাহার পর তুমি আমার সহিত রক্তবতীর নিকট যাইবে। রক্তবতীকে দেখিলে তোমার মন অনেক শান্ত হইবে।”

 মশা, খর্ব্বুর ও ব্যাঙ কঙ্কাবতীকে বুঝাইতে লাগিলেন। খর্ব্বুর বলিলেন,— “সংসার অনিত্য। জীবনের কিছুই স্থিরতা নাই। কখন কে আছে, কখন কে নাই। উঠ, মা, উঠ। তোমার পতির যথাবিধি সৎকার হইলে, কিছুদিন তুমি রক্তবতীর নিকটে গিয়া থাক। তাহার পর তোমার মা'র নিকট গিয়া রাখিয়া আসিব।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মহাশয়গণ! আপনারা আমার অনেক উপকার করিলেন। আমার জন্য আপনারা অনেক পরিশ্রম করিলেন। আপনাদিগের পরিশ্রম যে সফল হইল না, সে কেবল আমার অদৃষ্টের দোষ। ঈশ্বর আপনাদিগের মঙ্গল করিবেন। আপনারা যখন এত পরিশ্রম করিলেন, তখন এক্ষণে আমার আর একটি যৎসামান্য উপকার করুন। সেইটি করিয়া আপনারা স্ব স্ব গৃহে প্রতিগমন করুন। পতিপদে আমি আমার প্রাণ সমৰ্পণ করিয়াছি। এই— যে আমার শরীর দেখিতেছেন, এ প্রাণহীন জড়দেহ। এক্ষণে আমি পতিদেহের সহিত আমার এই জড়দেহ ভস্ম করিব। সে নিমিত্ত যাহা কিছু প্রয়োজন, আপনার সেই সমস্ত উপকরণের আয়োজন করিয়া দিন।”

 মশা বলিলেন,— “ছি মা ও কথা কি মুখে আনিতে আছে? পতিহারা হইয়া শত শত সতী এ পৃথিবীতে জীবিত থাকে। ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া পরোপকারে জীবন অতিবাহিত করে।”

 খর্ব্বুর ও ব্যাঙ সকলেই কঙ্কাবতীকে সেইরূপ নানা প্রকারে বুঝাইতে লাগিলেন।

 নাকেশ্বরী বলিল,— “মাসী!”

 মাসী বলিল,— “উ!”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “মানুষটাকে সৎকার করিবে যে! তাহা হইলে আর আমরা কি ছাই খাইব?”

 মাসী বলিল,— “হঁ!”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “এই ছুঁড়ির জন্যই যত বিপত্তি। এখন ছুঁড়িও যাতে মরে, এস তাই করি।”

 এই কথা বলিয়া নাকেশ্বরী, খর্ব্বুর প্রভৃতির নিকট আসিয়া আবির্ভূত হইল। নাকেশ্বরী বলিল,— “তোমরা কি পরামর্শ করিতেছ? কঙ্কাবতীকে দেশে লইয়া যাইবে? লইয়া যাও, তাহাতে আমাদের কোনও ক্ষতি নাই। কিন্তু এ ধর্ম্মভূমি ভারতভূমির নিয়ম তোমরা জান না। লোকের এখানে ধর্ম্মগতপ্রাণ। শোকেই হউক আর তাপেই হউক, সহসা যদি কেহ মুখে একবার বলিয়া ফেলে যে, “আমি পতির সঙ্গে যাইব, তাহা হইলে তাহাকে যাইতেই হইবে, সতী হইতেই হইবে। না হইলে পতিকুল, পিতৃকুল, মাতৃকুল, সকল কুল ঘোর কলঙ্কে কলঙ্কিত হইবে। পিতা, মাতা, ভ্রাতা, আত্মীয়বর্গের মস্তক অবনত হইবে। সে কলঙ্কিনী একেবারেই পতিত হইবে। তাহার সহিত যিনি আচার-ব্যবহার করিবেন, তিনিও পতিত হইবেন। তাই বলিতেছি, তোমরা ইহাকে ঘরে লইয়া যাও, তাহাতে আমাদের কিছু ক্ষতি নাই; কিন্তু শুন মশা মহাশয়। শুন খর্ব্বুর মহারাজ। আমি এ কথা তোমাদিগের আত্মীয়-স্বজনকে বলিয়া দিব। তোমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা কিছু তোমাদিগের মত নাস্তিক নন। তাঁরা নিশ্চয় ইহার যথাশাস্ত্র বিচার করিবেন। তখন দেখিব, পুত্র-কন্যার বিবাহ দাও কোথায়?”

 নাকেশ্বরীর কথা শুনিয়া মশার ভয় হইল। আজ বাদে কাল তার রক্তবতীর বিবাহ দিতে হইবে। পাত্র না মিলিলে তাঁকে ঘোর বিপদে পড়িতে হইবে। মশা তাই খর্ব্বুরকে জিজ্ঞাসা

কঙ্কাবতী
১২৩