পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করিলেন,— “সত্য সত্য কি ভারতের এই নিয়ম?”

 খর্ব্বুর উত্তর করিলেন,— “পূর্ব্বে এইরূপ নিয়ম ছিল, সত্য। কিন্তু এক্ষণে সহমরণ উঠিয়া গিয়াছে। সাহেবেরা ইহা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন।”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “উঠিয়া গেছে সত্য। কিন্তু আজকাল শিক্ষিত পুরুষদিগের মত কি জান? পূর্ব্বপ্রথা সমুদয় পুনঃপ্রচলিত করিবার নিমিত্ত তাহারা যথোচিত প্রয়াস পাইতেছেন। শোকবিহ্বলা ক্ষিপ্তপ্রায়া জননী-ভগিনীদিগকে জ্বলন্ত অনলে পোড়াইবার নিমিত্ত আজকালের শিক্ষিত পুরুষেরা নাচিয়া উঠিয়াছেন। এইরূপ ধর্ম্মের আমরা সম্পূর্ণভাবে পোষকতা করিয়া থাকি।”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “আমার যাই থাকুক কপালে, আমি কঙ্কাবতীর সহিত আচার-ব্যবহার করিব। তাহাতে আমাকে পতিত হইতে হয় সেও স্বীকার। আত্নীস্বজন আমাকে পরিত্যাগ করেন করুন, তাহাতে আমি ভয় করিব না! তা বলিয়া, অনাথা বালিকাটি যে অসহনীয় শোকে ক্ষিপ্তপ্রায়া হইয়া পুড়িয়া মরিবে, তাহা আমি চক্ষে দেখিতে পারিব না।”

 মশা বলিলেন,— “আমারও মত, ভীরু কাপুরুষের মত কার্য্য করিতে পারিব না। আমি কঙ্কাবতীকে ঘরে লইয়া যাইব।”

 ব্যাঙ বলিলেন,— “আমারও ঐ মত। কাপুরুষ হয়, মানুষেরা হউক। আমি হইব না।”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “ধর্ম্মের তোমরা কিছুই জান না! ঘোর অধর্ম্মে যে তোমরা পতিত হইবে, সে জ্ঞান তোমাদের নাই। ইনি যদি সতী না হন, তাহা হইলে ইহাকে প্রাজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে তবুও ইনি ঘরে যাইতে পাইবেন না। মুর্দাফরাশে ইঁহাকে লইয়া যাইবে, মুর্দ্দাফরাশের রমণী হইয়া ইঁহাকে চিরকাল থাকিতে হইবে।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন, “এই কথা লইয়া আপনারা বৃথা তর্ক-বিতর্ক করিতেছেন। আমি নিশ্চয় প্রাণত্যাগ করিব। বাঁচিয়া থাকিতে আর আপনারা আমাকে অনুরোধ করিবেন না, যেহেতু আপনাদিগকে কথা আমি রক্ষা করিতে পারিব না। এক্ষণে আমার প্রার্থণা এই যে, সতী হইতে যাহা কিছু আবশ্যক, সেই সমুদয় দ্রব্যের আয়োজন করিয়া দিন। আমার আর একটি কথা আছে আমাদিগের যে ঘাট আছে, সেইখানে আমার শাশুড়ী-ঠাকুরাণীর চিতা হইয়াছিল, সেই স্থানে চিতা করিয়া আমি আমার পতির সঙ্গে পুড়িয়া মরিব।”

 কঙ্কাবতীর দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা দেখিয়া অতি দুঃখের সহিত, অগত্যা এ-কার্য্যে সকলকে সম্মত হইতে হইল।

 মশা বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! যদি তুমি নিতান্তই এই দুষ্কর কার্য্য করিবে, তবে আমি আমার বাড়ীতে সংবাদ দিই, আমার স্ত্রীগণ ও রক্তবতী আসিয়া তোমার সহিত সাক্ষাৎ করুন।”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “আমিও তবে আমার স্ত্রীকে সংবাদ দিই। আমার আত্মীয়-স্বজনকে সঙ্গে লইয়া তিনিও আসুন। সহমরণের উপকরণ আনয়ন করুন ও নাপিত, পুরোহিত, ঢাকিঢুলির নিকট সংবাদ পঠাইয়া দিন।”

 ব্যাঙ বলিলেন,— “আমিও আমার আত্মীয়-স্বজনের নিকট সমাচার পাঠাই।”

 বাহিরে হাতী বলিলেন,— “আমিও আমার জ্ঞাতি বন্ধুদিগকে ডাকিতে পাঠাই।”

 নাকেশ্বরী বলিল,— “মাসী! তবে আমরা আর বাকী থাকি কেন? তুমি তোমার ঝুড়িতে গিয়া চড়। পৃথিবীতে যত ভূতিনী-প্রেতিনী আছে, সহমরণ দেখিবার জন্য তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ কর। আজকাল সহমরণ কিছু আর প্রতিদিন হয় না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা সকল ভূতিনী-প্রেতিনীই সহমরণ দেখিয়া পরম পরিতোষ উপভোগ করিবে।”

১২৪
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ