পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এইরূপে সকলেই আপনার আত্মীয়-স্বজনকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তাহার পর, খেতু ও কঙ্কাবতীকে লইয়া, সকলে হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। রাত্রি একপ্রহরের সময় সকলে কুসুমঘাটীর ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলেন।

 কঙ্কাবতী যে-স্থান নির্দেশ করিয়া দিলেন, সেই স্থানে চিতা সুসজ্জিত হইল। এই সময় রক্তবতী ও রক্তবতীর মাতাগণ সেই শ্মশানঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সহমরণের সমুদয় উপকরণ লইয়া নাপিত-পুরোহিত ঢাকী-ঢুলি সঙ্গে করিয়া খর্ব্বুর সপ্তহস্তপরিমিত স্ত্রী ও তাঁহার আত্মীয়-স্বজন আপন আপন বালক-বালিকাগণকে লইয়া সেইখানে আসিলেন। ব্যাঙ ও হস্তীর আত্মীয়বর্গও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নানাদিক হইতে অসংখ্য ভূতিনীগণও আগমন করিল। সেই শ্মশানঘাটে সে রাত্রিতে, মনুষ্য ও ভূত-ভূতিনী ভিন্ন, অপরাপর নানাপ্রকার জীবজন্তুর সমাগম হইল! সে রাত্রিতে কুসুমঘাটীর শ্মশানঘাট জনাকীর্ণ হইয়া পড়িল।

 রক্তবতী কঙ্কাবতীর গলা জড়াইয়া ধরিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে রক্তবতী বলিলেন,— “পচাজল! তুমি কোথায় যাও? আমাকে ছাড়িয়া তুমি কোথায় যাইবে? আমি কখনই তোমাকে যাইবে দিব না।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “পচাজল! তুমি কাঁদিও না। সতী হইয়া পতি-সঙ্গে আমি স্বর্গে চলিলাম। সে কার্য্যে তুমি আমাকে বাধা দিও না। কি করিব পচাজল! মন্দ অদৃষ্ট করিয়া এ পৃথিবীতে আসিয়াছিলাম; এ পৃথিবীতে সুখ হইল না। পতির সহিত এখন স্বর্গে যাই। আশীর্ব্বাদ করি, রাজপুত্র মশা তোমার বর হউক। পতি লইয়া তুমি সুখে ঘরকন্না কর। আমার মত হতভাগিনী যেন শক্রও না হয়।”

 এই বলিলেন,— “ভাই পচাজল! এই তিনছড়া মালা গাঁথ। একছড়া তুমি লাও, আর দুইছড়া আমার জন্য রাখ, প্রয়োজন আছে।”

 সকলে তখন খেতুকে চিতার উপর রাখিলেন। প্রেত-পিণ্ডাদি যথাবিধি প্রদত্ত হইল। নাপিত আসিয়া কঙ্কাবতীর নখ কাটিয়া দিল। তাহার পর কঙ্কাবতী শরীর হইতে সমুদয় অলঙ্কারগুলি খুলিয়া ফেলিলেন। হাতের চুড়ি ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন। সেই ভাঙ্গা চুড়ি লোকে হুড়াহুড়ি কাড়াকড়ি করিয়া কুড়াইতে লাগিল। কেন না, কাহাকেও ভূত-প্রেতিনীতে পাইলে, এই চুড়ি রোগীর গলায় পরাইয়া দিলে, ভূত-প্রেতিনী ছাড়িয়া যায়।

 কঙ্কাবতী হাতের নোয় খুলিয়া স্নান করিয়া আসিলেন। খর্ব্বুরপত্নী তখন তাঁহাকে রক্তবর্ণের চেলির কাপড় পরাইয়া দিলেন। রাঙাসূতা দিয়া হাতে আলতা বাঁধিয়া দিলেন। চুলের উপর থরে থরে চিরুণি সাজাইয়া দিলেন। কপাল জুড়িয়া সিন্দুর ঢালিয়া দিলেন।

 এইরূপ বেশভূষা হইলে, কঙ্কাবতী আচমন করিয়া তিল-জল-কুশহস্তে পূর্ব্বমুখে বসিলেন। পুরোহিত তাঁহাকে মন্ত্র পড়াইয়া এইরূপ সঙ্কল্প করাইলেন।

 “অদ্য ভদ্রমাসে, কৃষ্ণপক্ষে, তৃতীয়া তিথিতে ভরদ্বাজ গোত্রের আমি শ্রীমতী কঙ্কাবতী দেবী,—বশিষ্ঠকে লইয়া অরুদ্ধতী যেরূপ মহামান্যা হইয়াছিলেন,— আমিও যেন সেইরূপ, মানুষের শরীরে যত লোম আছে, তত বৎসর স্বর্গে পতিকে লইয়া সুখে থাকিতে পারি। আমার মাতৃ-পিতৃ ও শ্বশুরকুল যেন পবিত্র হয়। যতদিন চতুৰ্দশ ইন্দ্রের অধিকার থাকিবে, ততকাল পর্যন্ত যেন অন্সরাগণ, আমাদিগের স্তব করিতে থাকে। পতির সঙ্গে যেন সুখে থাকি। ব্রহ্মহত্যা, মিত্রহত্যা ও কৃতঘ্নতাজন্য যদি পতির পাপ হইয়া থাকে, আমার স্বামী যেন সে পাপ

কঙ্কাবতী
১২৫