পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিবাহ করিবেন না। সম্প্রতি আমি জয়দেপুরে গিয়াছিলাম। সেখানকার জমীদার আমাদের ঘর। তিনি এই গ্রামে বিবাহ করেন। তাঁহার পুত্র নবীন যেমন কুলে-শীলে, সেইরূপ রূপে-গুণে সুপাত্র। সে মাতুলালয়ে আসিয়াছিল। গৃহিণীর বড় সাধ হইল যে, তাহাকে জামাতা করেন। আমি তাহার পিতার নিকট গিয়া হাতে পৈতা জড়াইয়া কত কাঁদিলাম। তিনি তিন হাজার টাকা চাহিলেন! তিন হাজার টাকা কোনও পুরুষে কখনও চক্ষে দেখি নাই। যেমন উচ্চ আশা করিয়াছিলাম, সেইরূপ ফল পাইয়া আস্তে আস্তে ফিরিয়া আসিলাম।”

 এককড়ি পুনরায় বলিলেন,— “তাহার পর আবার বিপদের উপর বিপদ। এই গ্রামে বদরুদিন সেখ বলিয়া একজন ডাক্তার আছেন। এখন আর তিনি বদরুদিন নাই। চিকিৎসা করিয়া তিনি অনেক অর্থ উপাৰ্জ্জন করিয়াছিলেন। ক্রমে জমীদারী কিনিলেন, এই স্থানে ইমারত বাড়ী করিলেন, ও টাকার মহাজনী করিতে লাগিলেন। তিনি এখন অনেক টাকার মানুষ! যখন তাহার অনেক টাকা লইল, তখন তিনি “বদরুদিন সেখ” নাম ছাড়িয়া “বৈদ্যনাথ সেন” নাম লাইলেন। টাকা হইলে কি না হয়? ব্রাহ্মণ কায়স্থ সকলেই তাঁহাকে লইয়া চলিতে লাগিল। কিছুদিন পরে একগাছা সূতা তিনি পরিলেন। প্রথম প্রথম সূতাগাছটি কোমরে রাখিতেন, নাভির উপরে তুলিতেন না। ক্রমে আস্তে আস্তে সূতাগাছটি কাঁধের উপর তুলিলেন। তখন সেটি যজ্ঞোপবীত হইয়া দাঁড়াইল। সেই সময় তিনি “সেন” ছাড়িয়া “শর্ম্মা” উপাধি গ্রহণ করিলেন। আজকাল তিনি “দেব-শর্ম্ম।” হইয়াছেন। এখন তাঁহার নাম বৈদ্যনাথ দেব-শর্ম্মা। তাহার পুত্র গবীরুদিন এখন গোবিন্দচন্দ্র দেবশর্ম্মা হইয়াছেন। বেশ চলিয়া গিয়াছেন। কোনও উৎপাত নাই। গোপীকৃষ্ণ চক্রবর্ত্তীর কন্যার সহিত গোবিন্দচন্দ্রের বিবাহ হয়। সেই উপলক্ষে দেশদেশান্তর হইতে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত জমা হইয়াছিলেন। এক এক ঘড়া আর দশ দশ টাকা হইতে একশত টাকা নগদ দিয়া পণ্ডিতসমাজকে বিদায় করিয়াছিলেন। চারিদিকে একেবারে ধন্য ধন্য পড়িয়া গিয়াছিল। গোবিন্দচন্দ্রের সম্প্রতি গৃহশুন্য হইয়াছে। হিরণ্ময়ীর রূপের কথা শুনিয়া হিরণ্ময়ীকে বিবাহ করিবেন এই তাঁহার একান্ত ইচ্ছা। হিরণ্ময়ীর সহিত বিবাহ না দিলে তিনি আত্মহত্যা হইয়া মরিবেন, বাপ-মার এই কথা বলিয়াছিলেন। আমি বৈদ্যনাথ দেবশৰ্মার ৫০০ টাকা ধারি। তিনি আমার নামের ডিক্রি করিয়া রাখিয়াছেন। তিনি আমাকে ডাকাইয়া প্রথম নানা প্রলোভন দেখাইলেন। অনেক টাকা দিবেন, অনেক গহনা দিবেন, কত কি বলিলেন। আমি যখন তাঁহার কথায় স্বীকৃত হইলাম না, তখন নানারূপ ভয় দেখাইলেন। আমাকে জেলে দিবেন, বৃদ্ধবয়সে কয়েদখানায় পাঠাইবেন, এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। আজ যেন তিনি বৈদ্যনাথ দেবশর্ম্মা হইয়াছেন, কিন্তু আমি ত’ জানি তিনি কে? না হিন্দু, না মুসলমান, না ব্রাহ্মণ, না কায়স্থ। প্রাণ থাকিতে তাঁর ঘরে আমি কি করিয়া কন্যা দিই? এখন বুঝিয়া দেখুন, আমি কিরূপ বিপদে পড়িয়াছি। আপনি যদি উদ্ধার করেন, তবেই হয়।”

 ব্রাহ্মণের বিপদের কথা শুনিয়া নিধিরাম অনেকক্ষণ মৌন থাকিয়া অবশেষে বলিলেন;— “আচ্ছা মহাশয়! ক’ল্য আপনাকে আমি একথার উত্তর দিব।”

১৩৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ