পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 হিরণ্ময়ী বলিলেন,— “দেখুন মহাশয়। আমি এক্ষণে আর বালিকা নাই। সকল কথা আমি বুঝিতে পারি। মনে মনে আপনাকে পতি বলিয়া বরিয়াছি। আপনি আমাকে বিবাহ করেন, সে নিমিত্ত দেবতা-দিগকে কত ডাকিয়াছি। চন্দ্র-সূর্য্যকে সাক্ষী করিয়া বলিতেছি, আপনি আমার পতি। চিরকাল আপনার দাসী হইয়া থাকিব। আমি কুলটা নই যে, দুই দিন পরে আমার মনের পরিবর্ত্তন হইবে। বৃদ্ধ হউন, আতুর হউন, যাহা হউন, দেবতাদিগকে সাক্ষী করিয়া বলিতেছি, আপনার পদে এখন যেরূপ আমার মতি রহিয়াছে, চিরকাল সেইরূপ থাকিবে।”

 এই বলিয়া হিরন্ময়ী সে স্থান হইতে চলিয়া যাইলেন। নিধিরাম সেই দিক পানে একদৃষ্টি চাহিয়া রহিলেন। মনে মনে করিলেন,— “ভাল গঙ্গাস্নান করিতে আসিয়াছিলাম। খুব ফাঁদে পড়িলাম। এ-বয়সে আবার এরূপ মন কেন? হিরণ্ময়ীতে প্রাণ আমার একেবারে জড়িত হইয়া গিয়াছে। হিরণ্ময়ী বিনা জীবন বৃথা। পুস্তকে যে ভালবাসার কথা বলে, তাই এই। ভালবাসার কথা শুনিলে পূর্ব্বে হাসিয়া উড়াইয়া দিতাম, মনে করিতাম, সে আবার কি? বুড়োবয়সে আচ্ছা আমাকে ধেড়ে রোগে ধরিল!”

 নিধিরামের সহিত হিরণ্ময়ীর বিবাহ স্থির হইল। পাড়া-প্রতিবাসী সকলে জানিল। বদরুদ্দিন সেখ অর্থাৎ বৈদ্যনাথ দেবশর্ম্মাও একথা শুনিলেন। চুপি-চুপি তিনি ডিক্রিখানি জারি করিলেন। এককড়ির নামে ওয়ারেণ্ট বাহির করিলেন। বিবাহের একদিন থাকিতে তাহাকে ধরাইয়া রামনগরের জেলখানায় পাঠাইয়া দিলেন।

 এককড়ির ঘরে কান্নাকাটি পড়িল। হিরণ্ময়ী ও তাঁহার মাতা মাটিতে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন। “বৃদ্ধবয়সে জেলখানায় গিয়া বাবা আর বাঁচিবেন না,” এই কথা বলিয়া হিরণ্ময়ী ঘোরতর বিলাপ করিতে লাগিলেন।

 নিধিরাম বলিলেন,— “হিরণ্ময়ি! কাঁদিও না। আমি দেশে যাই। সেখানে আমার যাহা কিছু ভূমি-সম্পত্তি আছে, তাহা বেচিলে পাঁচশত টাকার অধিক হইবে, তাহা আনিয়া তোমার পিতাকে আমি উদ্ধার করিব।”

 এইরূপ অনেক বুঝাইয়া, অনেক প্রবোধ দিয়া, নিধিরাম বাড়ী হইতে বাহির হইলেন। প্রথম রামনগর যাইয়া জেলখানায় এককড়ির যাহাতে কোনও ক্লেশ না হয়, এইরূপ উপায় করিয়া আপনার দেশাভিমুখে চলিলেন। দেশে উপস্থিত হইয়া আপনার সমুদয় ভূমি-সম্পত্তি ৭০০ টাকায় বিক্রয় করিলেন। ৬০০ টাকায় নোট একটি টিনের চোঙ্গের ভিতর রাখিয়া ও একশত টাকা নগদ গেজেতে করিয়া আপনার কোমরে বঁধিলেন। একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া পুনরায় চন্তীপুর অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

চতুর্থ অধ্যায়

তুমুল ঝড়

নিধিরাম নৌকা করিয়া আসিতেছেন, এমন সময় একদিন অতিশয় দুর্য্যোগ আরম্ভ হইল। সমস্ত দিন পূর্ব্ব-বাতাস চলিতে লাগিল, টিপটপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল, নদীতে ঘোরতর তরঙ্গ

১৪০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ