পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যায় ও জলের ঝাপটা তাঁহার নাকে-মুখে প্রবেশ করিয়া শ্বাসরোধের উপক্রম হয়। ক্রমে তাহার হাত-পা অবশ হইয়া পড়িতে লাগিল। আসন্নকাল উপস্থিত জানিয়া নিধিরাম ভগবানকে স্মরণ করিতে লাগিলেন। “হা, হিরণ্ময়ি! তোমার পিতাকে উদ্ধার করিতে পারিলাম না, তোমার সে মধুমাখা মুখখানি আর দেখিতে পাইলাম না। হে করুণাময় জগদীশ্বর! তুমি আমার হিরণ্ময়ীকে সুখী করিও।” আসন্নকালে নিধিরাম মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলেন।

 হাত-পা নাড়িতে না পারিয়া নিধিরাম জলে ডুবিলেন। প্রাণের মায়া সহসা কেহ ছাড়িতে পারে না। জলে ডুবিয়াই পুনরায় একটু হাত-পা নাড়িতে চেষ্টা করিলেন। তাহাতে আর একবার উপরে ভাসিয়া উঠিলেন। কিন্তু আর বল নাই। শরীর অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। ঘোর কালনিদ্রা তাঁহাকে ক্রমে ঘিরিতেছে। পুনরায় ডুবিলেন। ডুবিতে না ডুবিতে তাঁহার পায়ে কি ঠেকিল। আমনি তাঁহার একটু চমক হইল। পায়ে যে দ্রব্য ঠেকিল, তাহা তিনি ধরিলেন, একটু বল প্রকাশ করিয়া পুনরায় উপরে ভাসিয়া উঠিলেন। মনকে প্রবোধ দিয়া নিদ্রাবেশ দূর করিলেন। পুনরায় তাহার চেতনা হইল। জীবনের আশা হইল, তাহাতে শরীরে কিঞ্চিৎ শক্তিরও সঞ্চার হইল। দেখিলেন যে, একগাছি কাছি তাহার পায়ে ঠেকিয়াছিল। টানিয়া দেখিলেন যে, সেই কাছি অতি দূরে কিছুতে বাধা আছে। নিধিরাম ভাবিলেন, কাছির অপরদিক হয় জলমগ্ন নৌকায় বাধা আছে, না হয় নদীর কিনারায় খোঁটায় বাধা আছে। বায়ুর প্রবলবেগে কাছি ডুবিয়া যায় নাই, সরলভাবে ভাসিতেছিল। তিনি সেই কাছিটি ধরিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। পর্ব্বতাকার তরঙ্গের ভিতর দিয়া অগ্রসর হওয়া সহজ কথা নহে। যাহা হউক, অতি কষ্টে কিছু দূর গিয়া তিনি মাটি পাইলেন। ক্রমে কোমার জলে গিয়া দাঁড়াইলেন। তখনও ঢেউ তাহার মাথার উপর দিয়া যাইতেছিল। ক্রমে কিনারায় গিয়া উঠিলেন। দেখিলেন যে, কাছিগাছাটি একটি খোটায় বাঁধা আছে। শরীর একবারে অবশ হইয়া পড়িয়াছিল। সেই খোঁটাটি ঠেশ দিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রইলেন। উপর হইতে চারিদিকে পাড় ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল। নিধিরাম ভাবিলেন, যদি প্রাণরক্ষা হইল, শেষে কি আবার মাটি-চাপা পডিয়া মরিব না কি!

 নিধিরাম দাঁড়াইলেন। অনেক পরিশ্রম করিয়া পাড়ের উপর গিয়া উঠিলেন। পাড়ের উপর দাঁড়াইতে না দাঁড়াইতে বাতাসে তাঁহাকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। ঘোর অন্ধকার! কোন দিকে লইয়া যাইতে লাগিল, তাহা তিনি বলিতে পারেন না। মনে করিলেন যে, “যদি একটি গাছ পাইতো ধরিয়া বসিয়া থাকি; তাহার পর সকাল হইলে গ্রাম অনুসন্ধান করিব।” একবার একটি গাছ পাইলেন, কিন্তু সেটি চারা বাবলাগাছ। আগ্রহের সহিত ধরিতে গিয়া, তাহার সমস্ত হাতে কাটা ফুটিয়া গেল। বাতাসে পুনরায় তাঁহাকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। একবার তাহাকে পাড় হইতে নদীর ভিতর ফেলিয়া দিল। অতি কষ্ট পুনরায় তিনি উপরে উঠিলেন। পুনরায় বাতাসে তাঁহাকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল, পাছে পুনরায় নদীর ভিতর ফেলিয়া দেয়, এই ভয়ে তিনি বুকে হাঁটিয়া যাইতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে একটি ঝোঁপের নিকট উপস্থিত হইলেন। ঝোঁপের ভিতর প্রবেশ করিবার মানসে যেই অগ্রসর হইয়াছেন, আর অমনি ফোঁস করিয়া একটি শব্দ হইল। নিধিরাম ভাবিলেন,— “মন্দ কথা নয়! সর্পাঘাতটিই বা বাকি থাকে কেন?” অপরদিকে গিয়া একটি গাছ পাইলেন। গাছটি ধরিয়া বসিলেন। অল্পক্ষণ বিশ্রাম করিয়া মনে মনে ভাবিলেন,— “চারদিক জলে ডুবিয়া গিয়াছে।” এই স্থানটি উচ্চ। এখানে অনেক সাপ আসিয়া আশ্রয় লইয়া থাকিবে। মাটিতে এরূপভাবে বসিয়া থাকা ভাল নয়।

১৪২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ